ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান প্রতিদিনই এক নতুন বিপর্যয়ের জন্ম দিচ্ছে। বেসামরিক মানুষ, বিশেষ করে শিশু, নারী ও বৃদ্ধদের উপর এভাবে আগ্রাসন চালিয়ে ইসরায়েল যুদ্ধের সব ধরনের মানবিক সীমা অতিক্রম করেছে বলেই মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এদিকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে হামাসের সম্মতির খবরে কিছুটা আশার আলো দেখছে আন্তর্জাতিক মহল।
রোববার দিবাগত রাত। গাজার আল-দারাজ এলাকার একটি স্কুল চত্বরে আশ্রয় নেওয়া শত শত বাস্তুচ্যুত মানুষের ওপর বোমাবর্ষণ করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। যার ফলে আগুনে পুড়ে মারা যায় কমপক্ষে ১৮টি শিশু, মোট প্রাণ হারিয়েছে ৩৬ জন। একই সময়ে গাজার উত্তরের শহর জাবালিয়াতে এক পরিবারের ওপর চালানো আরেক হামলায় নিহত হন সেই পরিবারের ১৯ সদস্য। ইসরায়েল এই হামলাগুলো চালায় “নিরাপত্তা রক্ষার” নামে, কিন্তু বাস্তবে তা রূপ নিচ্ছে এক নৃশংস গণহত্যায়। একই সময়ে হামাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি হওয়ার ঘোষণা দেয়, যার মাধ্যমে যুদ্ধ থামানোর নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
গাজার ফাহমি আল-জারজাওয়ি স্কুলটি বেইত লাহিয়া থেকে বাস্তুচ্যুত শত শত মানুষের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছিল। সেই মানুষগুলোর বেশিরভাগই ছিল নারী, শিশু এবং বৃদ্ধ। কিন্তু এই স্কুলেই যেন নেমে আসে মৃত্যু। ইসরায়েলি বিমান থেকে ছোড়া বোমা মুহূর্তেই আগুনে পরিণত হয়। আগুনে পুড়ে যায় দুটি শ্রেণিকক্ষ, যা ঘুমানোর জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। গাজার সিভিল ডিফেন্স বিভাগের মুখপাত্র জানান, এ পর্যন্ত অন্তত ২০টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, যাদের অধিকাংশই শিশু। এমনকি দগ্ধ দেহগুলোর অনেকগুলোর পরিচয় শনাক্ত করাও কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শী রামি রফিক বলেন, ‘মুহূর্তের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ছাইয়ের ওপর পড়ে থাকা দগ্ধ শরীরগুলো দেখে আমার ছেলে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।’ ১১ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, এক শিশু আগুনে পুড়ে যাওয়ার সময় ক্লাসরুম থেকে বের হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এই ভিডিও বিশ্বজুড়ে হৃদয়বিদারক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। স্থানীয় প্রতিবেদন জানায়, এই হামলায় হামাস পুলিশের তদন্ত প্রধান মোহাম্মদ আল-কাসিহ, তার স্ত্রী ও সন্তানও নিহত হয়েছেন।
একই সময়ে গাজার উত্তরের শহর জাবালিয়াতে আব্দ রাব্বো নামের এক পরিবারের বাড়িতে চালানো আরেকটি হামলায় ওই পরিবারের ১৯ সদস্যই নিহত হন। হাসপাতালগুলোতেও থেমে নেই সংকট। ইসরায়েলি বাহিনী ইন্দোনেশীয় ও আওদা হাসপাতালের চারপাশ ঘিরে রেখেছে। এই দুটি হাসপাতাল যেকোনো সময় ইসরায়েলি হামলার শিকার হতে পারে।
এই ভয়াবহতার মধ্যে কিছুটা আশার আলো জাগিয়েছে যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা। সোমবার (২৭ মে) এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা জানান, হামাস যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মতি দিয়েছে। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, দুই ধাপে ১০ জন জীবিত ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেবে হামাস, আর ইসরায়েল মুক্তি দেবে দীর্ঘ সাজাপ্রাপ্ত বহু ফিলিস্তিনি বন্দিকে। প্রস্তাবের মধ্যে ৭০ দিনের যুদ্ধবিরতি, ইসরায়েলি বাহিনীর গাজা থেকে স্থায়ী প্রত্যাহার এবং বন্দি বিনিময় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সম্প্রতি ইসরায়েলি পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার নিসিম ভাতুরি বলেছেন, ‘গাজাকে ছাই করে দিন।’ এই ঘৃণাজনক মন্তব্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেন বামপন্থি নেসেট সদস্য ওফের কাসিফ। কিন্তু পার্লামেন্ট কর্তৃপক্ষ বলেছে, এটি রাজনৈতিক মতামত এবং অপরাধ নয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েলের আচরণ নিয়ে আবারও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
যেখানে প্রতিদিন গড়েই শত শত ফিলিস্তিনি, বিশেষ করে শিশু মারা যাচ্ছে, সেখানে জরুরি খাদ্য ও ওষুধের অভাব প্রকট আকার নিয়েছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, ১৯ মে থেকে গাজায় ৩৮৮টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে। অথচ জাতিসংঘ বলছে, প্রতিদিন গাজায় ৫০০-৬০০ ট্রাক প্রয়োজন। এই বিশাল ঘাটতি মৃত্যুর মিছিলকে আরও দীর্ঘ করছে।
এই বর্বরতা বন্ধে আন্তর্জাতিক মহলও সরব হতে শুরু করেছে। রোববার স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে ২০টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বৈঠকে বসে। স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসে ম্যানুয়েল আলবারেস জানান, ইসরায়েল হামলা বন্ধ না করলে তাদের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৫৩ হাজার ৯৭৭ জন ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে ১৬ হাজার ৫০০ জনই শিশু। আহত হয়েছে আরও ১ লাখ ২২ হাজার ৫৯৩ জন। হামাসের যুদ্ধবিরতিতে সম্মতির খবরে অনেকেই আশা করছেন, হয়তো এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে গাজা। তথ্যসূত্র : বিবিসি, আল-জাজিরা, মিডল ইস্ট মনিটর
আপনার মতামত লিখুন :