ইউটিউব যখন কেবল বিনোদনের নয়, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে উঠছে, তখন কিছু কনটেন্ট নির্মাতা রয়েছেন যারা এই প্ল্যাটফর্মকে স্রেফ ভাইরাল ভিডিও বা জনপ্রিয়তা অর্জনের যন্ত্র হিসেবে দেখেন না। বরং এটিকে ব্যবহার করেন অজানা, অচেনা, অবহেলিত, ভয়ংকর, কিংবা উপেক্ষিত পৃথিবীকে তুলে ধরতে। তেমনই একজন ইউটিউবার হলেন রুহি চেনেট।
তুরস্কের এই কনটেন্ট নির্মাতা দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়িয়ে তুলে ধরছেন নানা জাতি, সংস্কৃতি ও জীবনের অজানা গল্প। তার ভিডিওগুলো একাধারে যেমন শিক্ষামূলক, তেমনি রহস্যময়, মাঝে মাঝে আতঙ্কিত করার মতো। তবে সব কিছু ছাপিয়ে এগুলোর প্রতিটিই একেকটি জীবন্ত ডকুমেন্টারি, যেখানে উঠে আসে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের বাস্তবতা।
রুহি চেনেট ১৯৯০ সালের ২০ অক্টোবর তুরস্কের আইদিন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শৈশব কাটান মানিসা ও বন্দির্মা শহরে। রুহি উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য ২০০৭ সালে ভারতে আসেন। সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ২০১১ সালে দেশে ফিরে যান।
২০১২ সালে ইউটিউব ক্যারিয়ার শুরু করেন রুহি তবে সাধারণ ভ্লগ বা রিভিউ কনটেন্ট দিয়ে নয়, বরং শুরু থেকেই তার লক্ষ্য ছিল—আলোকপাত করতে হবে সেইসব জায়গায়, যেখানকার গল্প সাধারণ গণমাধ্যমে আসে না, যেগুলো হয়তো কারও জানা নেই কিংবা ইচ্ছেও নেই জানার। এই উদ্দেশ্য থেকেই তিনি শুরু করেন তার অসাধারণ অভিযাত্রা। কখনো আফ্রিকার ক্ষুধাপীড়িত অঞ্চল, কখনো ভারতের দলিত সম্প্রদায়, কখনো আবার আফগানিস্তান বা সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদে গিয়ে নিজ চোখে দেখেন মানুষের জীবনসংগ্রাম, সংগ্রহ করেন ইতিহাস, অভিজ্ঞতা আর তুলে ধরেন দর্শকের সামনে।
রুহির ভিডিওর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার কনটেন্টের বৈচিত্র্য ও গবেষণানির্ভরতা। প্রতিটি ভিডিও তৈরি হয় গভীর প্রস্তুতি নিয়ে। তিনি শুধু ভিডিও ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ান না, বরং তার আগেই পড়ে নেন সেই অঞ্চলের ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজব্যবস্থা, এমনকি রাজনীতি পর্যন্ত। তারপর তিনি সেই এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করেন, নানা প্রশ্ন করেন, অনেক সময় তাদের দৈনন্দিন জীবনে মিশে যান। এর ফলে তার ভিডিওগুলো শুধুমাত্র ভ্রমণ কনটেন্ট নয়, বরং হয়ে ওঠে একেকটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন, যেটি দেখতে গিয়ে দর্শক শুধু বিনোদিত হন না, বরং জানেন অনেক কিছু, ভাবেন আরও বেশি।
এজন্যই রুহির ভিডিওর দর্শক কেবল ভ্রমণপ্রেমীরা নন, বরং সমাজবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, ইতিহাস, এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী ব্যক্তিরাও নিয়মিত অনুসরণ করেন তাকে। তার ভিডিওতে আপনি যেমন পাবেন পাকিস্তানের ব্লাসফেমি আইনে অভিযুক্ত মানুষের কথা, তেমনি পাবেন উত্তর কোরিয়ার গোপন সমাজব্যবস্থা, ভারতের কুমারটুলির মৃৎশিল্প, কিংবা আফ্রিকার ত্বকভিত্তিক বৈষম্যের বাস্তবতা। অর্থাৎ রুহির কনটেন্ট কখনো কখনো সাংবাদিকতাকেও অতিক্রম করে যায়, কারণ তিনি গিয়ে হাজির হন সেইসব জায়গায়, যেগুলো সাধারণ সাংবাদিকদেরও নাগালের বাইরে।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে রুহি চেনেটের বড় গুণ হলো তার সাহস। একজন ইউটিউবার হিসেবে উত্তর কোরিয়া, আফগানিস্তান, সোমালিয়া, কিংবা ইরানের মতো দেশে গিয়ে ভিডিও বানানো নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিক কাজ। এসব দেশে গিয়ে কেবল ভিডিও ধারণ করাই নয়, সেখানকার জনগণের সঙ্গে সরাসরি কথোপকথন, ঘরোয়া পরিবেশে বসে আলাপ, এমনকি অনেকে যেখানে যেতে ভয় পান, সেসব জায়গায় অবলীলায় ঘোরাঘুরি করেন রুহি। থেমে যাননা তিনি। কারণ তার লক্ষ্য পরিষ্কার—এই পৃথিবীকে সত্যর আলোয় তুলে ধরা।রুহির ভিডিওগুলো ইউটিউবের প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে হয়ে দাঁড়ায় এক ধরনের নন-ফিকশন সাহিত্য, যেখানে চরিত্র আছে, সংকট আছে, এবং আছে অজানাকে জানার এক অন্তর্লীন আকাঙ্ক্ষা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ইউটিউবের যুগে যেখানে অনেকেই শুধু ‘ভিউ’-এর পেছনে ছোটেন, সেখানে রুহির মতো একজন নির্মাতা প্রমাণ করেন যে, ভালো কনটেন্ট এখনও দর্শক খুঁজে নেয়, এবং জ্ঞানভিত্তিক কাজেরও বিশাল দর্শকসমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। তার ইউটিউব চ্যানেল এখন কয়েক মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবারে পৌঁছেছে। রুহি চেনেট আসলে আমাদের শেখান—বিশ্ব অনেক বৈচিত্র্যময়, এবং প্রতিটি সংস্কৃতি, প্রতিটি সমাজের নিজস্ব গল্প আছে বলার মতো।
আপনার মতামত লিখুন :