রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় গ্রেফতার আতঙ্ক! ঢাকায় জনজীবনে সীমাহীন মহাদুর্ভোগ!


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুলাই ২৪, ২০২৪, ৫:৪৮ পূর্বাহ্ণ /
রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় গ্রেফতার আতঙ্ক! ঢাকায় জনজীবনে সীমাহীন মহাদুর্ভোগ!
  • ঘরে খাবার নেই, কাজ না থাকায় শ্রমজীবীদের দুর্বিষহ জীবন, বাইরে কারফিউ,ঘরে গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট সাধারণ মানুষের সর্বত্রই অনিশ্চয়তা

সড়কে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ, পুলিশের গণগ্রেফতার, গ্যাস-পানির সংকট, নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্য, ইন্টারনেট বন্ধ, শ্রমজীবী নিম্নবিত্তদের কাজ নেই, গণপরিবহন বন্ধ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে রাজধানীর মানুষের জীবন। কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, গ্যাস-বিদ্যুৎ নেই, বাইরে বের হলে আইন-শৃংখলা বাহিনীর জেরার মুখে পড়তে হয়, ঘরের মধ্যেও ভীতি আইন-শৃংখলা বাহিনী কখন ধরে নিয়ে যায়, রিকশা চললেও মার্কেট ও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় দোকানের কর্মী ও পরিবহন শ্রমিক এবং ফুটপাত বন্ধ থাকায় লাখ লাখ হকার দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন।

একই অবস্থা মধ্যবিত্ত ও কর্মজীবী মানুষের মধ্যে। বিশেষ করে যাদের ঘরে ১২ থেকে ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ও ছেলে রয়েছে তাদের ভীতি আরো বেশি। আইন-শৃংখলা বাহিনীর গণগ্রেফতারের ভয়ে মা-বাবারা চরম আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। এ চিত্র সারাদেশের। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, বগুড়া, দিনাজপুর, বরিশাল, খুলনা, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের ইনকিলাব প্রতিনিধিরা জানান, ছাত্র আন্দোলনকারীদের মিছিল-বিক্ষোভ দেখা না গেলেও কারফিউ জারি থাকায় আইন-শৃংখলা বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। আন্দোলনের সময় ভয়ের মধ্যে থাকলেও এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পুলিশ।

মোড়ে মোড়ে তল্লাশি এবং সেনাবাহিনীর টহল চলছে। যে সব এলাকায় বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর ও সংঘাত সংঘর্ষ হয়েছে সে সব এলাকার বাসা-বাড়ি ও মেসবাড়িতে আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালাচ্ছেন। সন্দেহজনক অনেককে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছেন। রাজধানী ঢাকার মতোই জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতে গ্রেফতার আতঙ্ক চলছে। সবকিছু বন্ধ থাকায় নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে পড়ে গেছেন মফস্বল শহরের লাখো মানুষ। ঘরে খাবার নেই, কারফিউর কারণে ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। কতদিন এ অবস্থা চলবে সেটাও জানেন না। এতে করে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছেন লাখো মানুষ।

এছাড়াও গতকালও রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের যোগাযোগ কার্যত বিচ্ছিন্ন ছিল। যাত্রাবাড়ি থেকে পদ্মাসেতু হয়ে বরিশালগামী কিছু যানবাহন পুলিশ প্রহরায় চলাচল করতে দেখা গেলেও অন্য কোনো মহাসড়কে গণপরিবহন ও দূর পাল্লার কোনো যানবাহন চলতে দেখা যায়নি। ইন্টারনেট বন্ধের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকায় কোথাও মিছিল-বিক্ষোভ সমাবেশের খবর পাওয়া যায়নি। হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগের বাতিল ও কোটা নিয়ে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারির পর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা কার্যত নীরব রয়েছেন। তবে তারা সংবাদ সম্মেলন করেছেন বলে জানা গেছে। তবে ঢাকার আকাশে হেলিকপ্টারের টহল দেখা গেছে। দুপুর একটা থেকে ৫টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টা কারফিউ শিথিল করা হলেও গণপরিবহন চলেনি, রাজধানীর কোনো মার্কেট খোলেনি।

যারা ঘর থেকে বের হয়ে রিকশায় চলাচল করেছেন তারাও পথে পথে তল্লাশির মুখে পড়েছেন। মহানগরীর মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট এবং অনেক এলাকায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প বসানো হয়েছে। সড়কে সেনাবাহিনীর সারি সারি আরর্মার্ড পারসোনাল ক্যারিয়ার (এপিসি) দেখা গেছে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি আতঙ্ক বিরাজ করছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকার জুরাইন, লোহারপুল, রামপুরা, নতুন বাজার, মিরপুর-১০, মিরপুর মাজার, সায়েদাবাদ, গাবতলি, বছিলা, খিলগাঁও, বাবু বাজার, ফার্মগেইট, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন সকালে শ্রমিকদের হাট বসে। মানুষ নিজেদের কাজ করাতে এসব জায়গা থেকে শ্রমিক ভাড়া করে নিয়ে যান। গতকাল দেখা গেছে এসব জায়গার আশপাশে সেনাবাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এমনিতে কারফিউ তারপর সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ফলে শ্রমজীবী মানুষ শ্রম বিক্রি করতে সকালে এসব হাটে আসতে ভয় পাচ্ছেন।

শহিদুল নামের একজন শ্রমজীবী জানান, তিনি কয়েকদিন ধরে ঘরে বসে রয়েছেন। কাজকর্ম না থাকায় কখনো আধাপেটা কখনো না খেয়ে দিন পার করছেন। তিনি বলেন, কারফিউ জারির পর থেকে রাজধানীর শ্রমিক হাটে কেউ কাজ করাতে শ্রমিক ভাড়া করতে হাটে আসেন না। শনির আখড়ার গোবিন্দপুর বাজারে মুরগির দোকানে কাজ করেন পারভেজ ইসলাম। তিনি জানালেন, কারফিউ জারির পর দোকান বন্ধ। তাই কাজ নেই। এতে করে বাসায় খাওয়া দাওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তবে বুধবার দোকান খোলার সম্ভাবনা রয়েছে।

গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, মতিঝিল, পুরান ঢাকার কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেল, কারফিউ শিথিলের সময় কিছু চায়ের দোকান খোলা রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন ফুটপাত দখল করে যে হাজার হাজার দোকান বসে সেগুলো নেই। গুলিস্তানের হাফিজুর নামের এক চা দোকানদার বলেন, পাশের বিল্ডিংয়ে থাকি তাই দুপুরে দোকান খুলেছি। কাষ্টমার তেমন নেই। তবে দোকান খোলা রাখতে পারলে বিকেলে বেচাকেনা হতে পারে।

কারফিউর মধ্যেই যাত্রাবাড়ি থানার ধোলাইপাড় ও দয়াগঞ্জের বেশ কয়েকটি দোকান খোলা রাখা হচ্ছে। মধ্য ও নিম্ন আয়ের পরিবারের সদস্যরাই মূলত এসব দোকান পরিচালনা করেন। এসব দোকানের পাশেই কারফিউর মধ্যেই ভিড় করছেন অনেক শ্রমজীবী মানুষ। তারা জানান, কয়েক দিন ধরে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই। আধা পেটা খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন। কারফিউর মধ্যে বাইরে কেন? প্রশ্ন শুনেই কম বয়সী একজন শ্রমজীবী বলেন, কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, ইন্টারনেট থাকলে ঘরে বসে মোবাইল দেখতাম। এখন সেটাও হচ্ছে না। তাই বাইরে বসে আছি বন্ধুদের সঙ্গে।

‘পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে’ প্রশ্ন শুনেই পাশে বসা রহিমউল্লাহ নামের একজন বৃদ্ধ বললেন, ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিন ও এরশাদের সময় কারফিউ হলে মানুষ ঘর থেকে বের হতো না। এখন কারফিউ কেউ মানছে না। প্রতিদিন সারাদিন শত শত মানুষ রাস্তায় চলাচল করছে। বাস মিনিবাস টেম্পু চলাচল না করলেও রিকশা ও ব্যাটারি চালিত রিকশা চলছে। কোথাও কোথাও লাইনের ব্যাটারির অটো চলছে সমান তালে। আমাদের কাজ নেই তাই বসে আছি।

রাজধানীর কয়েকটি এলাকা ঘুরে এবং মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিম্নবিত্ত মানুষের মতোই কম বেতনের চাকরিজীবী, পেশাজীবী তথা মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের বেহালদশায় পড়ে গেছেন। জীবন-সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। প্রিপেইড মিটারের কারণে গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি সংকটে রয়েছেন। বাজারে প্রতিটি পণ্যের দাম বেশি। তাছাড়া ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তাদের স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন ঘটেছে। সাধারণ মানুষ বলছেন, অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঘোষিত কারফিউ কতদিন চলবে সেটা জানা যাচ্ছে না। আবার সড়ক মহাসড়কে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন না থাকলেও পুলিশ গ্রেফতার বেড়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল থেকে ছাত্রলীগ যেমন বিতাড়িত হয়েছিল; আন্দোলনের মুখে এতোদিন পাড়া মহল্লায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা ভয়ে ঘর থেকে বের হননি। সেনা টহল ও পুলিশের গণগ্রেফতার শুরু হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতারা স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীদের আটক করানোর চেষ্টা করছেন। ফলে যে সব পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, তাদের উঠতি বয়সী ছেলেদের মধ্যে গ্রেফতার ভীতি বাড়ছে।

আজিমপুরের একজন স্থায়ী বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গতকাল পুলিশ এলাকায় গ্রেফতার অভিযান চালিয়েছে। এতে করে এলাকার মানুষের মধ্যে নতুন করে গ্রেফতার ভীতি শুরু হয়েছে। শাহজাহানপুর এলাকা থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানিয়ে একজন জানান, কারফিউর চেয়ে মানুষের মধ্যে এখন গ্রেফতার আতঙ্ক বেশি।

বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের বড় ও মাঝারি মানের নেতারা যে সব মহল্লায় থাকেন সে সব মহল্লায় উঠতি বয়সের ছেলে এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাতে বাসায় ঘুমাতে পারছেন না। তারা সন্ধ্যার পর অন্যত্র রাত কাটাচ্ছেন। এসব শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়েরা চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনযাপন করছেন।