রাজনীতিতে নতুন মোড়!


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : মে ২৭, ২০২৫, ৯:৩৮ পূর্বাহ্ণ /
রাজনীতিতে নতুন মোড়!
  • এনসিপি অন্তর্বর্তী সরকারের ভ্যানগার্ড? প্রধান উপদেষ্টা জাপান থেকে ফিরে অথবা ঈদুল আজহার পর দেয়া হতে পারে নির্বাচনের টাইমফ্রেম ঘোষণা সচিবালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলন ও আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের বিরুদ্ধে এনসিপির অবস্থান

প্রবাদ-প্রবচনে রয়েছে ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়’। এই প্রবচনে আসল লোকের চেয়ে অনুচরের চোটপাট বেশি বোঝানো হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের চেয়ে তাদের সহযোগীরা আস্ফালন বেশি দেখাচ্ছে। ফলে নির্বাচন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যমুনায় রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের প্রকৃত চিত্র মানুষ বুঝতে পারছে না।

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কয়েক দফায় অনেকগুলো দল বৈঠক করেছে। দলগুলোর বেশির ভাগই নিজেদের মতো করে দাবি তুলে ধরেছে। বেশির ভাগ দল স্বল্প সংস্কার করে নির্বাচন তথা ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের দাবি করেছেন। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। কিন্তু ‘বিএনপি ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি’ চেপে গিয়ে সব দল পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে বলে প্রচার করা হয়। সূত্রের দাবি, নির্বাচনের টাইমফ্রেম দেয়া বিলম্ব হচ্ছে শুধু ছাত্র সমন্বয়কদের দল এনসিপিকে সংগঠিত করার সুবিধা দেয়ার জন্য। সে কারণে সংস্কারের পর নির্বাচন ধোঁয়া তোলা হয়েছে। তবে তারেক রহমানের পরিচ্ছন্ন কর্মসূচি রাজনীতির গতি-প্রকৃতি পাল্টে দিতে পারে।

গতকালও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, নির্বাচন ও সংস্কারের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। এ বিষয়ে এক ধরনের কল্পিত বিরোধ তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কোনো বিরোধ নেই। নির্বাচনী প্রক্রিয়া এক রকম এবং জাতীয় সনদ তৈরির চেষ্টা, সেটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যেই করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে যেন রাজনৈতিক কাঠামো এমনভাবে হয়, যার মধ্যে স্বৈরাচারী ব্যবস্থাটা পুনরায় উত্থিত হতে না পারে এবং নাগরিকদের অধিকারগুলো সুরক্ষিত থাকে।

ব্যাংকিং সেক্টরে বেহাল দশা। বিপর্যয়ের মুখে অর্থনীতি। নতুন বিনিয়োগ নেই। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় সরকারি কর্মচারীদের স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল। এনবিআরে কয়েক দিন ধরে চলছে আন্দোলন। সিটি করপোরেশনের গেইটে তালা ঝুলছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সারা দেশে আন্দোলন কর্মসূচি দিয়েছে। বিএনপি ২৮ মে অনুষ্ঠেয় তারুণ্যের সমাবেশে ১৫ লাখ লোকের সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। আইএসপিআরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কোনো ধরনের বিরোধ বা মুখোমুখি অবস্থান নেই। তারা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রের স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সরকার ও সেনাবাহিনী একসঙ্গে কাজ করছে।

এনবিআর ও সচিবালয়ে কর্মকর্তাদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে এনসিপির দুই নেতার হুমকি, বিএনপির তারণ্যের সমাবেশে ১৫ লাখ লোক জড়ো করার ঘোষণা, কর্মচারীদের সচিবালয় অচল করে রাখার ঘোষণা এবং প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপে কি ঘটতে যাচ্ছে রাজনীতিতে?

দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও জনপ্রিয় দল বিএনপি এবং দলটির সমমনা প্রায় অর্ধশত দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করছে। তারেক রহমান বলেছেন, ‘ডিসেম্বরে নির্বাচন দিতে হবে। দেশে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকার না থাকায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এক অনিশ্চিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। যে কারণে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ প্রতিদিন বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে নেমে আসছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই মুহূর্তে তাদের দাবি শোনার কেউ নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের নৈতিক ও রাজনৈতিক বৈধতার সঙ্কট হয়তো নেই। তবে এই সরকার জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক নয়। জনগণকে অন্ধকারে রেখে বা রাজনৈতিক দলগুলোকে অনিশ্চয়তায় রেখে শেষ পর্যন্ত কোনো পরিকল্পনা কার্যকর ও টেকসই হবে না। তারেক রহমানের এই বক্তব্য দলের নেতাকর্মীসহ সারা দেশের সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করছে।

যমুনায় আয়োজিত প্রধান উপদেষ্টার সংলাপে দেখা যায় বিএনপির চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টিকে-এনসিপি। কারণে-অকারণে এনসিপি নেতারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করেন। জামায়াতের নেতারা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। অন্তর্বর্তী সরকার এনসিপি ও জামায়াতকে অধিক গুরুত্ব দিলেও দল দু’টি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত নয়। অভিযোগ রয়েছে নতুন দল এনসিপি প্রতিষ্ঠা ও সারা দেশে দলটির সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতিশীলতায় সরকারের পরোক্ষ সহযোগিতা রয়েছে। যার জন্য জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন দাবি করা হচ্ছে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের ভ্যানগার্ড হিসেবে এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ ও হান্নান মাসুদ সচিবালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলন ঠেকিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন ও রাজনীতির নিয়ে পর্দার আড়ালে কী চলছে? কেউ বলছেন, জাপান থেকে দেশে ফিরে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নতুন কোনো ঘোষণা দিতে পারেন। কেউ বলছেন, ঈদের পর রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটবে। মানুষ দেখছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় সংলাপ চলছে। কিন্তু সঙ্কট উত্তরণের দৃশ্যমান উন্নতি ঘটছে না। ফলে গত কয়েক দিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে চাপা উত্তেজনা ও গুমোট পরিস্থিতি। এমন গুমোট চিত্র খালেদ মোশাররফের তিন দিনের শাসনামলে দেখা গেছে। ১৯৭৫ সালের ৪ থেকে ৭ নভেম্বরে বঙ্গভবনে ‘সংলাপ’ দেখেছে। ২০১৮ সালে রাতের ভোটের আগে গণভবনে রাজনৈতিক দলগুলোর ‘সংলাপ’ দেখেছে। কিন্তু সঙ্কটের সুরাহা হয়নি। ভারতের সেবাদাস দাম্ভিক খালেদ মোশাররফ ৩ নভেম্বর ক্ষমতা দখল করে বঙ্গভবনে সংলাপ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ৭ নভেম্বর সিপাহি জনতার বিপ্লব ঘটে গেছে। ২০১৮ সালে গণভবনে হাসিনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করলেও তিনি ভারতের নীলনকশার নির্বাচন করেছেন। নির্বাচনের আগের রাতেই তিনি ভোট করে ফেলেছেন। এখন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে নির্র্বাচনের টাইমফ্রেম ইস্যুতে রাজনৈতিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। তবে পর্দার আড়ালে এ নিয়ে ‘কিছু একটা চলছে’ মনে করছেন কেউ কেউ।

সম্প্রতি সেনাপ্রধানের বক্তব্যে নতুন মোড় নেয়। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা সেনাপ্রধান বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। এ মন্তব্যকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় উঠে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় বিএনপিসহ অর্ধশতাধিক দলের ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি। কিন্তু ৫ আগস্টের বিপ্লবের পথ ধরে জন্ম নেয়া জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে সময়ের প্রয়োজন। ফলে প্রধান উপদেষ্টা সঙ্কট সুরাহায় নির্বাচনের টাইমফ্রেম ঘোষণা দিতে নানান বাধার মুখে পড়ছেন। তবে প্রশাসন দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা জাপান থেকে ফিরে অথবা ঈদুল আজহার পর নতুন ঘোষণা দিতে পারেন। কারণ তিনি পরিচ্ছন্ন ইমেজ নিয়ে ক্ষমতা থেকে চলে যেতে নির্বাচনের টাইমফ্রেম ঘোষণা করতে পারেন। সূত্রের দাবি, যমুনার সংলাপে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনহীন জামায়াত ও এসসিপিকে যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে তা অন্যান্য দলগুলো ভালো চোখে দেখছে না।

সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিল দাবিতে আন্দোলনে দিনভর প্রায় অচল ছিল প্রশাসনের কেন্দ্র সচিবালয়। সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫-কে কালাকানুন উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবিতে এই আন্দোলন করছেন সচিবালয় কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। তাদের চলা আন্দোলনের মধ্যেই রাতে অধ্যাদেশটির গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। ওদিকে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কর্মবিরতির কারণে অচলাবস্থা বিরাজ করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআরে। গত রোববার দিনভর কর্মবিরতি শেষে বিকেলে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমও বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয়া হয় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে। নতুন কর্মসূচি ঘোষণার পর সন্ধ্যায় অর্থ মন্ত্রণালয় ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে এনবিআর ভাগ করার অধ্যাদেশ সংশোধন করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এরপরই ঐক্য পরিষদ তাদের কর্মসূচি স্থগিত করে। তবে অসহযোগ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এনবিআরে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে কর্মবিরতি ও অসহযোগ চলায় এই প্রতিষ্ঠানে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনের অচলাবস্থাও কাটেনি। অবরুদ্ধ করে কর্মসূচি পালন করেন তার সমর্থকরা।

এদিকে আজ মঙ্গলবার দুই দিনব্যাপী কলমবিরতি কর্মসূচি শুরু করতে যাচ্ছে প্রশাসন ক্যাডার বাদে সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলার প্রতিবাদে এবং ‘কৃত্য পেশাভিত্তিক’ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, উপসচিব পদে পদোন্নতিতে কোটা বাতিল ও সব ক্যাডারের মধ্যে সমতা আনার দাবিতে এ কর্মসূচি পালিত হবে।

সচিবালয় ও এনবিআরের আন্দোলন ঠেকানোর হুমকি দিয়েছে এনসিপির দুজন নেতা। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ বলেছেন, ‘আজ সচিবালয়, এনবিআর কিংবা পোর্টে যারা স্ট্রাইক করছেন, তাদের বলছিÑ বিপ্লব ওখানেও হবে।’ গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে হান্নান মাসউদ এই হুঁশিয়ারি দেন। এর আগে চট্টগ্রামে দলের এক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহও কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, কর্মচারীরা সরকারের কাজে বাধা দিলে, হুমকি দিলে জনগণই তাদের বিকল্প খুঁজে নেবে। সংস্কারে বাধা দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সরকারকে জিম্মি করলে পরিস্থিতি ভালো হবে না।