রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের সাথে জামায়াতে ইসলামীর সখ্যতা বাড়ছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানের ফেইসবুকে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে এমন ধারণার তৈরি হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে বিএনপি যেখানে সরকারের অনিয়ম ও ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরে সমালোচনা করছে, সেখানে তাদের মিত্র দল হিসাবে জামায়াতের আমীরের অনেকটা প্রশংসা সূচক স্ট্যাটাসকে সরকারের সাথে তাদের সখ্যতা বাড়ার ইংগিত বহন করে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর তার স্ট্যাটাসে সরকারের সরাসরি কোনো প্রশংসা না করলেও প্রকারান্তরে তাতে সরকারকে এক ধরনের অভিনন্দন জানানো হয়েছে। কেননা, এতে সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কোনো সমালোচনামূলক কথা নেই। এ সেতু হওয়াতে তিনি মহান আল্লার দরবারে শুকরিয়া আদায় করেছেন। একই সাথে সেতু নির্মাণে যার যতটুকু অবদান তার বিচারের ভার জনগণের কাছে ছেড়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া তিনি বলেছেন, পৃথিবীতে যা কিছুই কল্যাণকর হয়, তার জন্য মহান প্রভুর শুকরিয়া আদায় করাই হচ্ছে মানুষের দায়িত্ব।
একই সাথে সেতুতে যানবাহনে উচ্চ হারের টোলের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তার এই স্ট্যাটাসে তিনি সেতুকে যেভাবে কল্যাণকর বলে উল্লেখ করেছেন, তাতে সরকার অবশ্যই খুশি হবে। সরকারের খুশি করার জন্য এ ধরনের বিবৃতি বা স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে। আর এতে দুইয়ে দুইয়ে চার হওয়ার মতোই সরকারের সাথে তাদের এক ধরনের সখ্যতা তৈরির সহজ সমীকরণের আঁচ করছেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এ বিষয়ে গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, পদ্মা সেতু একটি জাতীয় সম্পদ। এটা নিয়ে কেউ অখুশি নয়। তাই জামায়াতের আমীর শুকরিয়া আদায় করে ব্যক্তিগত ফেইসবুক আইডিতে স্ট্যাটাস দিতেই পারেন। এতে সরকারের সাথে এক ধরনের সখ্যতা তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে, বিএনপির সাথে দূরত্ব বেড়েছে এ বিষয়ে উপসংহার টানাটা যুক্তিযুক্ত হবে না। এ বিষয়ে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।
বিএনপির সাথে জামায়াতে ইসলামীর দূরত্ব বাড়ছে এমন গুঞ্জন রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক দিন ধরে শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন বিএনপির সঙ্গে জামায়াতও বর্জন করে। শীর্ষ নেতাদের রক্ষা এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে জামায়াত-শিবিরের তৃণমূল নেতৃত্বকে কড়া মূল্য শোধ করতে হয়। রাজপথে নিহতের সংখ্যাও কম নয়। গ্রেফতার, রিমান্ড ছিল মামুলি ব্যাপার। সেই থেকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক নিয়েও তৈরি হয় নানা আলোচনা-টানাপড়েন। আন্তর্জাতিক মহলের একটি অংশেরও আপত্তি লক্ষ্য করা যায় জামায়াতকে নিয়ে।
বিএনপি নেতৃত্বও দৃশ্যত দুই ভাগ হয়ে যায়। একটি অংশ জামায়াতের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়। নানা টানাপড়েন তৈরি হয় বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে। নিবন্ধন হারানো জামায়াত দৃশ্যত জোটে কোণঠাঁসা হয়ে পড়ে। এরপর ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে গড়ে ওঠা ঐক্যফ্রন্ট জামায়াতের গুরুত্ব একেবারেই কমিয়ে দেয়। যদিও শেষ পর্যন্ত সে নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে অংশ নেয় জামায়াত। ভোট কী ধরনের হয়েছে তা না বললেও সে নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের বিপর্যয়ের বিষয়টি সবার জানা। নির্বাচনে জামায়াত একটি আসনেও জয়লাভ করেনি।
ভোটের পর নতুন করে হিসাব-নিকাশ শুরু হয় জামায়াতে। মূলত গত সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কও অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়ে। সে বিষয়টি এখন আরও স্পষ্ট হচ্ছে। বিএনপি বর্তমান সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের প্রস্তুতির অংশ হিসাবে এরই মধ্যে ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দলের অংশ সংলাপ করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে কোনো সংলাপ বা আলোচনা হয়নি। এ ব্যাপারে জামায়াতও নীরব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, জামায়াতের আমীরের ফেইসবুক স্ট্যাটাস আমি দেখিনি। তাই এ বিষয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই।
দল হিসেবে জামায়াত নতুন কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তারা স্বতন্ত্র রাজনীতি করবে। জোটের রাজনীতি পরিত্যাগ করে তারা এককভাবে তাদের আদর্শিক রাজনীতি নিয়ে অগ্রসর হবে। এক্ষেত্রে কোনো দলের সঙ্গে সমঝোতা থাকলেও থাকতে পারে। বর্তমানে জামায়াত তাদের নিবন্ধন হারিয়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে।
তাই তারা সরকারের সাথে এক ধরনের সমঝোতা করে নিবন্ধন পুনরুদ্ধারে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করতেই পারে। নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করার আহ্বান জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী সে সুযোগটি গ্রহণ করার জন্য সরকারের সমঝোতা করছে, এমন আলোচনাও রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :