রাষ্ট্রীয় মদদে ব্যাংকের লাখ লাখ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জানুয়ারি ৫, ২০২৫, ৯:৫৬ পূর্বাহ্ণ /
রাষ্ট্রীয় মদদে ব্যাংকের লাখ লাখ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে
  • কঠিন সিদ্ধান্তের পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের, আইনের আওতায় আনার দাবি করেছেন গ্রাহকরা

ব্যাংক খাতকে কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাকহোল) সঙ্গে তুলনা করেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি। কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ব্যাংক খাতে দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের পরিমাণ এখন ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা, যে অর্থ দিয়ে ১৩টি মেট্রোরেল বা ২২টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ব্যাংক খাতে, ফলে খাতটি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

ব্যাংক খাতের দুর্নীতিবাজেরা সবাই ছিলেন প্রভাবশালী। আর তাই ব্যাংক খাত থেকে গত কয়েক বছরে ব্যবসায়ী-ব্যাংকারদের যোগসাজশেই লাখ লাখ কোটি টাকা লোপাট হওয়ার হদিস পাওয়া গেছে। দায়িত্ব নিয়েই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, যারা নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে ব্যাংকের টাকা লোপাট করেছে এবং টাকা পাচার করে বিদেশে সম্পদ গড়েছে, এসব লুটেরাদের ছাড় দেওয়া হবে না।

শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি আরও বলেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তায় ব্যাংক দখল করা হয়েছে। শুধু একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতেই সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়া হয়েছিল। এরপর বড় অঙ্কের অর্থ দেশের বাইরে পাচার করা

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, একটি পরিষ্কার পথনকশা না থাকায় তড়িঘড়ি করে নেওয়া সংস্কার উদ্যোগ দুর্বল হয়ে পড়ছে। লুটপাটের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলো বন্ধ করা হবে, নাকি একীভূত হবে কিংবা মালিকানা বদল অথবা মূলধন জোগান দিয়ে শক্তিশালী করা হবে, এসব প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তরও মিলছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় ৫ মাস পেরিয়ে গেলেও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ হয়নি অনিয়ম কারীদের বিরুদ্ধে।

এ অবস্থায় ভবিষ্যতে টেকসই অর্থ ব্যবস্থার স্বার্থে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের। জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন গ্রাহকরাও। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ১৫ বছরে যে জঞ্জাল তৈরি হয়েছে তা পাঁচ মাসে সারবে না। সুদ ও ডলারের দাম নির্দিষ্ট করে রাখার পাশাপাশি নানা অনিয়ম হয়েছিল। তা জেনেও সবাই চুপ ছিল।

প্রকাশ্যে এসবের সমালোচনা করা যেত না, এখন তা করা যাচ্ছে। সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে বলার মতো কোনো সমাধান হয়নি। এখনো অনেকে সংস্কারের বিপক্ষে রয়ে গেছেন। এ জন্য এই খাতের সবাইকে যুক্ত করে সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিলে সমাধান মিলবে। তাহলে সামনে নতুন সরকার গঠন হলেও সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া যাবে।

দেশের অর্থ পাচারকারীদের ধরার দায়িত্ব পেয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক মহাপরিচালক মাসুদ বিশ্বাস নিজেই নিয়েছেন সেই সুযোগ- এমন অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পদত্যাগও করেন তিনি। পটপরবির্তনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের পালিয়ে থেকে পদত্যাগের ঘটনাও নজিরবিহীন। গত ১৬ বছরে লাখো মানুষের জমানো অর্থ ব্যাংক থেকে নানা কৌশলে আত্মসাতের মহোৎসবের সুযোগ দেয়ার কলঙ্কিত অধ্যায় রচনা হয়েছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই।

এমন বিশ্বাস হারা লোকের ভারেই সংকটে দেশের ব্যাংক খাত। খেলাপির খাতায় যোগ হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার কোটি টাকা। সরকার পতনের পর অনিয়মের নানা চিত্র গণমাধ্যমের পাতায় চিত্রায়িত হলেও সংস্কারের খাতায় কতটুকু লিপিবদ্ধ হচ্ছে এসব খতিয়ান? অর্থনীতি নিয়ে যারা প্রতিনিয়ত থাকেন নানা পর্যালোচনায়, তাদের মুক্ত বাক্যেই উঠে আসছে নতজানু পদক্ষেপের কথা।

অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবির বলেন, নামে-বেনামে টাকা চলে গেছে। এর সঙ্গে তো ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত আছেন। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের দিক থেকে কড়া বার্তা দেয়া উচিত। যেসব ব্যাংকে দুর্নীতির অভিযোগ আছে, সেগুলোকে প্রয়োজনে জনসমুক্ষে নিয়ে আসা দরকার। কিন্তু সেই ব্যাপারে কোনো ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই। ড. কবির বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এখন পর্যন্ত এই ব্যাংক খাতে যারা লুটপাটের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সেটা নেয়াও জরুরি।

আর্থিক খাতে কতটা অনিয়মে জড়িত ব্যাংকাররা, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বক্তব্যেও উঠে এসেছে ভয়াবহ চিত্র। গভর্নর বলেন, লোম বাছতে উধাও হতে পারে কম্বল। ভালো হওয়ার সুযোগ দিতে চান তিনি। গভর্নর বলেন, মানুষকে ভালো হতে দেন! ভুল করে থাকলেও কেউ শুদ্ধ হতে চাইলে, আমি সেটাই চাই। কিন্তু তারপরেও সে খারাপ কাজ করলে তাকে শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে। ঘুনে ধরা ব্যাংক খাতের সংস্কারে গভর্নরের এই বক্তব্যকে অযৌক্তিক বলছেন প্রবীণ ব্যাংকাররা।

এমটিবি’র এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংক খাত যে পর্যায়ে চলে এসেছে তাতে সংস্কার না হলে অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এই বাস্তবতা সবাইকে বুঝতে হবে। বর্তমান সরকার এটা বুঝতে পেরে উদ্যোগ নিয়েছে। সামনে যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, তাঁদেরও এই বাস্তবতা বুঝতে হবে। তা ছাড়া এখনই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে, বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা দিতে হবে।

অর্থনীতিবিদ ও জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, গত ৫৩ বছরের রেকর্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো লোককে পদত্যাগ করতে দেখা যায়নি। কিন্তু এবার পদত্যাগের কারণটা কী? কারণটা অবশ্যই তদন্ত করতে হবে। পরিচ্ছন্ন অর্থ কারবারে এখনো ব্যাংকেই নিজেদের আস্থায় রাখতে চান হাজার হাজার গ্রাহক। কিন্তু তাদের দাবি একটাই, লুটপাটকারীদের বিচার হতে হবে।