রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রধান উপদেষ্টার যে ৭ দফার প্রস্তাব


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : আগস্ট ২৫, ২০২৫, ৮:০৪ অপরাহ্ণ /
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রধান উপদেষ্টার যে ৭ দফার প্রস্তাব

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস -সংগৃহীত

যতদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা নিজেদের আবাসভূমিতে ফিরে যেতে না পারেন ততদিন পর্যন্ত তাদের বিষয়টি ও এর টেকসই সমাধানকে বৈশ্বিক অ্যাজেন্ডায় রাখার জন্য জোর দেন অধ্যাপক ইউনূস। রোহিঙ্গা সঙ্কটের টেকসই সমাধানে কক্সবাজারে আয়োজিত ‘স্টেকহোল্ডারস’ ডায়ালগে যোগ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ, স্বেচ্ছায় ও টেকসইভাবে রাখাইন রাজ্যে প্রত্যাবাসনের জন্য বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ তৈরিতে যৌথ প্রচেষ্টার লক্ষ্যে সাত দফা প্রস্তাব পেশ করেছেন তিনি। 

সোমবার (২৫ আগস্ট) সকালে এই সংলাপে যোগ দিতে কক্সবাজার পৌঁছান প্রধান উপদেষ্টা। এদিন বেলা ১১টার দিকে তিন দিনের এ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের বিশেষ অধিবেশন শুরু হয়। এতে মিয়ানমার ও আঞ্চলিক স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা, রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন এবং বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যৌথ প্রচেষ্টার আহ্বান জানানো হয়।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা কেবল কথার জালে বন্দী থাকতে পারি না। এখনই সময় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার। তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানের দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও। সঙ্কটের সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে ভাবা এবং তা বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখা সবার যৌথ দায়িত্ব। যতদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা নিজেদের আবাসভূমিতে ফিরে যেতে না পারেন ততদিন পর্যন্ত তাদের বিষয়টি ও এর টেকসই সমাধানকে বৈশ্বিক অ্যাজেন্ডায় রাখার জন্য জোর দেন অধ্যাপক ইউনূস।

গত মার্চ মাসে পবিত্র রমজানে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এবং তিনি নিজে কক্সবাজারে এক লক্ষাধিক রোহিঙ্গার সাথে ইফতারে যোগ দিয়েছিলেন বলে সেই স্মৃতিচারণও করেন তিনি।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমরা পরিষ্কারভাবে শুনেছি, রোহিঙ্গারা যত দ্রুত সম্ভব নিজ আবাসভূমিতে ফিরে যেতে চান। অনুষ্ঠানে ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা স্মরণ দিবস’ উপলক্ষে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্রও প্রদর্শন করা হয়।

এ সময় রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণভাবে মিয়ানমারে তাদের নিজ আবাসভূমিতে প্রত্যাবাসনের জন্য দৃশ্যমান আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা যা করছি, তা অব্যাহত রাখতে হবে।

এ সময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম (বীর প্রতীক), পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম, ইউএনএইচসিআরের সহকারী হাইকমিশনার রাউফ মাজুও বক্তব্য রাখেন।

প্রফেসর ইউনূসের সাত দফা প্রস্তাব

প্রথমতঃ রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ, স্বেচ্ছামূলক ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য একটি কার্যকর রোডম্যাপ তৈরিতে কাজ করতে হবে। কথার জালে আর বন্দি থাকা যাবে না।

দ্বিতীয়তঃ ২০২৫-২৬ সালের যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনার অর্থ ঘাটতি পূরণে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠী ও মানবিক অংশীদারদের অব্যাহত সহায়তা জরুরি।

তৃতীয়তঃ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এজন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মিকে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, জীবিকা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। একইসাথে মিয়ানমারের ভেতরে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের দ্রুত নিজ ঘরে ফিরতে দিতে হবে।

চতুর্থতঃ মিয়ানমারের ভেতরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা হ্রাস ও সংঘাত নিরসনে সংলাপ প্ল্যাটফর্ম জরুরি। রোহিঙ্গাদের সাথে গঠনমূলক আলোচনায় বসতে হবে যাতে পুনর্মিলন, অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়।

পঞ্চমতঃ আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকা অপরিহার্য। মানবপাচার, মাদকপাচার, ছোট অস্ত্রের চোরাচালানসহ সীমান্তবর্তী অপরাধ মোকাবিলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

ষষ্ঠতমঃ জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। মিয়ানমার, আরাকান আর্মি ও অন্যান্য সংঘাতপক্ষের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্কট নিরসনের স্বার্থে পদক্ষেপ নিতে হবে।

সপ্তমতঃ আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে), আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় চলমান জবাবদিহি প্রক্রিয়াকে আরো গতিশীল করতে হবে। আইসিজের দেয়া অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশ কার্যকর করতে হবে এবং গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের সূত্রপাত মিয়ানমারে, তাই সমাধানও মিয়ানমারেই নিহিত। দেরি না করে সব পক্ষকে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। গত বছর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার তিন দফা প্রস্তাবের ভিত্তিতেই এ বছর উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে তথ্য দেন তিনি। কক্সবাজারের এই সংলাপ নিউইয়র্কে সম্মেলনে একটি কার্যকর রোডম্যাপ তৈরিতে অবদান রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশ টেকসই সমাধানের পক্ষে নিরলসভাবে কাজ করছে।

২০১৭ সালে মাত্র কয়েক সপ্তাহে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করার বিষয়টি উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এখনো নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। এই পরিস্থিতিতে ইতিহাসের সঠিক পাশে দাঁড়ানোই নৈতিক দায়িত্ব বলে মত দেন অধ্যাপক ইউনূস।

তিনি বলেন, সীমিত সম্পদ ও সামর্থ্য সত্ত্বেও মানবিক বিবেচনায় তাদের জীবন রক্ষার জন্য রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছিল বাংলাদেশ। নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এটি প্রমাণ করে যে মানবজাতির সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সঙ্কটে আমরা তাদের প্রতি সহমর্মিতা ও সহানুভূতি দেখিয়েছি।

তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী সঙ্কটের মুখে আর চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর ভূমিকা অনেক বেশি জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি। এ সময় দাতা, অংশীদার, জাতিসঙ্ঘ সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং বিশ্বব্যাপী বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর অব্যাহত সহায়তা, সহযোগিতা ও সংহতির প্রশংসা করেন প্রধান উপদেষ্টা।

তিনি জানান, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছেন যা কক্সবাজারকে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে পরিণত করেছে। এছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রতিবছর প্রায় ৩২ হাজার নবজাতক জন্ম নিচ্ছে।

অন্যদিকে, মিয়ানমারে এখনো পাঁচ লাখেরও কম রোহিঙ্গা রয়েছে। এই চিত্র স্পষ্ট করে যে অব্যাহত নিপীড়নের কারণে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ছেড়ে যাচ্ছেন। গত আট বছরে বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠী বিশাল ত্যাগ স্বীকার করে আসছেন বলে মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি, সম্পদ, পরিবেশ ও প্রতিবেশ, সমাজ ও শাসনব্যবস্থার ওপর এর বিরাট প্রভাব পড়েছে।

এর আগে, রোববার (২৪ আগস্ট) কক্সবাজারে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘স্টেকহোল্ডারস ডায়ালগ: টেকঅ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’ শুরু হয়। রোহিঙ্গা সঙ্কটের টেকসই সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
সূত্র : ইউএনবি