

পুলিশের তথ্যমতে, গত বছরের ৪, ৫ ও ৬ই আগস্ট ঢাকা ও দেশের অন্তত ১২০টি থানায় হামলা হয়। এর মধ্যে ভাঙচুরের শিকার হয়েছে ৬২টি থানা। ৫৮টি থানা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ১১৪টি ফাঁড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১ হাজার ৭৪টি যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হামলা থেকে রেহাই পায়নি পুলিশ সদর দপ্তরও। ৫ ও ৬ই আগস্ট শুধু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি’রই ২১টি থানায় হামলা এবং ১৩টি থানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। লুট করা হয় থানা পুলিশের অস্ত্র-গোলাবারুদ। একইসঙ্গে থানায় জব্দকৃত মালামাল, নথিপত্র, পোশাক- সবকিছু নিয়ে গাড়ি ও আসবাবপত্রে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। সে সময় ডিএমপি’র সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত থানাগুলোর মধ্যে- যাত্রাবাড়ী, উত্তরা পূর্ব থানা, ভাটারা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বাড্ডা, শ্যামপুর, খিলগাঁও, আদাবর, পল্টন, শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল, ওয়ারী, খিলক্ষেত থানা অন্যতম। ঢাকার বাইরেও ক্ষতিগ্রস্ত থানার সংখ্যা কম নয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে একদল সুযোগসন্ধানী ৪ঠা আগস্ট দুপুরে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় হামলা চালিয়ে ১৩ জন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করে। আহত অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান আরও এক পুলিশ সদস্য। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানায় হামলা চালিয়ে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ৫ই আগস্ট বিকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত নোয়াখালীর চাটখিল ও সোনাইমুড়ী থানায় হামলা, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগর ঘটনায় সোনাইমুড়ী থানার তিন পুলিশসহ আটজন নিহত হন।
একই সময়ে ফরিদপুরে কোতোয়ালি থানায় হামলার ঘটনা ঘটে। ওই দিনে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া থানায় পুলিশের গাড়ি, মোটরসাইকেল ও থানা কার্যালয়ে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। একইদিন কক্সবাজার সদর থানা, ট্রাফিক পুলিশ অফিস, ঈদগাঁও থানা ভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। ৫ই আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় হামলা করে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ওইদিন সন্ধ্যায় টাঙ্গাইল সদর থানা, বিকালে ধনবাড়ী থানা ও বাসাইল থানায়ও হামলা চালানো হয়। একইদিনে মানিকগঞ্জের শিবালয় থানা, পাটুরিয়া নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি, সিংগাইরের ধল্লা পুলিশ ফাঁড়ি, পাটুরিয়া পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও মানিকগঞ্জ ট্রাফিক কার্যালয় ভাঙচুর করে দুর্বৃত্তরা। বগুড়ার সদর থানা, সার্কেল এসপি’র কার্যালয়, সদর পুলিশ ফাঁড়ি, ট্রাফিক পুলিশ অফিস, দুপচাঁচিয়া ও শেরপুর থানা ভাঙচুর করা হয়। ফেনী মডেল থানা, ছাগলনাইয়া, দাগনভূঞা ও মহিপাল হাইওয়ে পুলিশ বক্স ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়াও কুষ্টিয়া মডেল থানা, খোকসা থানা, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর, রামগঞ্জ, ঝিনাইদহের মহেশপুরের দত্তনগর পুলিশ ক্যাম্প, জয়পুরহাট সদর থানায় হামলাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। আর এসব থানা থেকেই অন্য মালামালের সঙ্গে লুট করা হয় থানায় মজুত থাকা আগ্নেয়াস্ত্র।
পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলছে, খাতা-কলমের হিসাবে বিভিন্ন থানা থেকে মোট ৫ হাজার ৭৬৩টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে। লুট হওয়া এসব অস্ত্রের মধ্যে গত ১০ই নভেম্বর পর্যন্ত মোট ৪ হাজার ৪২৩টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। সে হিসাবে বাকি ১ হাজার ৩৪০টি আগ্নেয়াস্ত্রের এখনো হদিস নেই। আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াও সে সময় থানা থেকে ৬ লাখ ৫২ হাজার ৮টি বিভিন্ন গোলাবারুদ লুট করা হয়। তন্মধ্যে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৭২৮টি গুলি উদ্ধার হয়েছে। এখনো ২ লাখ ৫৭ হাজার ২৮০টি গুলি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। পুলিশের এই তালিকার বাইরেও স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) বেশ কিছু অস্ত্র-গোলাবারুদ ওই সময়ে লুট বা খোয়া যায়, সেগুলোও সব উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আর থানাগুলোর মালখানায় ঠিক কী পরিমাণ অস্ত্র মজুত ছিল, নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলায় তা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি কেউ। তবে এসব লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশ, সেনাবাহিনী, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। গত ৫ই নভেম্বর সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাসদরের মিলিটারি অপারেশন পরিদপ্তরের (ডিএমও) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান মোহাম্মদ মনজুর হোসেন বলেছিলেন, লুট হওয়া বা খোয়া যাওয়া অস্ত্রের প্রায় ৮১ ভাগ অস্ত্র আমরা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। পাশাপাশি এই সময়ের মধ্যে ৭৩ ভাগ গোলাবারুদও উদ্ধার করা হয়েছে।
থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসেন বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান প্রেক্ষাপটে লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ৭৭ শতাংশ আগ্নেয়াস্ত্র এরই মধ্যে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ২৩ শতাংশ অস্ত্র উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, নিয়মিত সকল কার্যক্রমের পাশাপাশি আমরা অস্ত্র উদ্ধারের জন্য অভিযান পরিচালনা করে চলেছি। তবে এই কার্যক্রম শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়েই সব সম্ভব নয়। এজন্য আমাদের দেশের সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে। পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, লুট হওয়া এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদের অধিকাংশই এখন পেশাদার সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেছে। এর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়েও বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে বলেও খবর পাওয়া যাচ্ছে। এটা খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। সামনে জাতীয় নির্বাচন বা রাজনৈতিক কোন্দলেও এসব লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যেকোনো মূল্যে এসব আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে নিজেদের আয়ত্তে নিতে হবে। তা না হলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি সহ নৃশংস ঘটনা আরও বাড়তে পারে।
আপনার মতামত লিখুন :