শুধু দলীয় কর্মী নয়; জানতে হবে বাংলাদেশের পুরো সমাজকে, বিএনপিকে বলতে হবে, আমরা যুগপৎ বাঙালি ও মুসলমান


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : অক্টোবর ২, ২০২৫, ৯:৫৫ অপরাহ্ণ /
শুধু দলীয় কর্মী নয়; জানতে হবে বাংলাদেশের পুরো সমাজকে, বিএনপিকে বলতে হবে, আমরা যুগপৎ বাঙালি ও মুসলমান

॥ মোবায়েদুর রহমান ॥

জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মনোজগতেও এক বিরাট পরিবর্তন সাধন করেছে। এই বিপ্লব সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে এ দেশের তরুণ ও যুবসমাজকে। ধর্ম, বিশেষ করে পবিত্র ইসলামের কথা বলতে গিয়ে সমাজের তথাকথিত এলিটদের মধ্যে যে কুণ্ঠা ছিল, বিপ্লবের মধ্যে এবং বিপ্লবের পরে দেখা গেল, সেই টগবগে যুবক-যুবতীদের অধিকাংশই সেই কুণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ইসলামের বৈজ্ঞানিক ও আধুনিক স্বরূপ নিয়ে চর্চা করছেন। 

আমেরিকা, সুইডেন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি স্থানে এই ভাষ্যকারের আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব দেশে যারা মাস্টার্স করেছেন এবং তারপর যারা পিএইচডি করেছেন, সেই সব বাংলাদেশিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখন ইসলাম নির্দেশিত সেবামূলক কাজে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছেন। তারা বলেন, বিদেশে আমরা সার্ভিস ওরিয়েন্টেড কাজ করছি।

এসব দেশে এখন অনেক টেকনোক্র্যাট বাংলাদেশি উৎকোচ বা ঘুষ গ্রহণকে ঘৃণার চোখে দেখছেন। এসব উচ্চশিক্ষিত বাংলাদেশির প্রায় সবাই নিয়মিত জুমার নামাজ আদায় করছেন। এরা অনেকে জুমা বা এশার নামাজের পর নিজেরা মসজিদের অভ্যন্তরে ইসলাম যে বর্তমান যুগে সমাজ ও রাজনীতিতে প্রযোজ্য সেটি তুলে ধরছেন। এরা স্টাডি সার্কেল গঠন করে ইসলামকে বিজ্ঞানের সর্বশেষ স্তর, বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান (Astronomy) এবং জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানের (Astrophysics) আলোকে ব্যাখা করছেন।

বাংলাদেশেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইসলামকে আরো বেশি করে জানার আগ্রহ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলাম নিয়ে ছাত্র এবং শিক্ষকদের মধ্যে ইন্টার‌্যাকশন হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী ইসলাম নিয়ে যখন গভীর আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে তখন দেশের বৃহত্তম দল বিএনপির মধ্যম থেকে উচ্চস্তরের নেতৃত্বের মধ্যে ইসলাম থেকে পলায়নী মনোবৃত্তি লক্ষ করা যাচ্ছে। নর্থ-সাউথের বেশ কয়েকজন ছাত্র একটি ডিবেটিং ক্লাবে তাদের শিক্ষকদেরকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমেরিকার সমস্ত কাগজি মুদ্রা এবং সব ধরনের কয়েনের মধ্যে যদি ওহ এড়ফ ডব ঞৎঁংঃ (ঈশ্বরে আমাদের বিশ্বাস আছে) শব্দগুলো উৎকীর্ণ থাকতে পারে তাহলে ৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশের কাগজি মুদ্রা এবং কয়েনে ‘আল্লাহর প্রতি আমাদের আস্থা আছে’, শব্দগুলো উৎকীর্ণ করতে পারি না কেন?’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (সিএসই) বেশ কয়েকজন ছাত্র নিজেদের মধ্যে মিনি ডিবেট করেছেন। তারা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, সিনেট ও কংগ্রেস সদস্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিবৃন্দ, মন্ত্রীবৃন্দ (ওরা মন্ত্রী না বলে সেক্রেটারি বলেন) যদি পবিত্র বাইবেলে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করতে পারেন তাহলে আমাদের মুসলমান প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবৃন্দ, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ পবিত্র কুরআন শরিফে হাত রেখে এবং খ্রিষ্টান ও হিন্দু সদস্যরা পবিত্র বাইবেল ও গিতায় হাত রেখে শপথ গ্রহণ করতে পারেন না কেন?

তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে যখন এ ধরনের চেতনার উন্মেষ ঘটছে তখন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বের দাবিদার বিএনপির মধ্যে অনুরূপ চেতনার উন্মেষ ঘটছে না কেন?

বিএনপির শীর্ষ নেতাদের করতে হবে তাদের শেকড় সন্ধান। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া তার দলের সিনিয়র ও মধ্যম স্তরের নেতাদের জন্য এক ধরনের স্টাডি সার্কেল গঠন করেছিলেন। সেখানে দলের সিনিয়র ও মধ্যম স্তরের নেতাদের ক্লাস হতো। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বলে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া যে জাতীয়তাবাদ উদ্ভাবন করেছিলেন সেটি কোনো সস্তা চটকদার রাজনৈতিক স্লোগান ছিল না। তিনি তার আশেপাশে কিছু পতিত ব্যক্তিকে জায়গা করে দিয়েছিলেন।

তারা পড়াশোনা করে এবং গবেষণা করে এই মর্মে উপসংহারে এসেছিলেন যে, যদি বাংলাদেশের সমাজকে ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হয় তাহলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ দিয়ে চলবে না। এখন এক শ্রেণির ছদ্মবেশী প্রো-ইন্ডিয়ান এবং প্রো-আওয়ামী লীগ আঁতেল বোঝাতে চাচ্ছেন, ইনক্লুসিভ রাজনীতি বা সমাজনীতির অর্থ হলো আওয়ামী লীগকে অন্তর্ভুক্ত করা। শেখ মুজিব যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিলেন সেখানে অবাঙালিদের স্থান কোথায়? সে জন্যই তো মানবেন্দ্র নারায়ণ লার্মা শেখ মুজিবের জাতীয়তাবাদ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন বাংলাদেশ নামক ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ডের মধ্যে যারা বাস করেন সেই বাঙালি, সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, খাসিয়া, মনিপুরী, মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান প্রভৃতি সব ধর্ম ও নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত হবে আমাদের জাতীয়তাবাদ। তাই সেই জাতীয়তাবাদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ হবে না, হবে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ।

বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামল পর্যন্ত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। শেখ হাসিনা কালচারাল ফ্রন্টে আবার নতুন করে উদীচী, ছায়ানট প্রভৃতির মাধ্যমে সরকারি সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেন। তখন বিএনপি তো বটেই, অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ইসলামী রাজনৈতিক দলসহ সবার উচিত ছিল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বুলন্দ আওয়াজ উঠানো। কিন্তু তখন এরা হয় এই দুটি জাতীয়তাবাদের পার্থক্যই বুঝতে পারেননি, অথবা কলকাতা থেকে আমদানি করা বাঙালি সংস্কৃতির জোয়ারে ভেসে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্যই অনেক বড় কবি। রবীন্দ্র সঙ্গীত এই ভাষ্যকারেরও প্রিয় সঙ্গীত। কিন্তু তাই বলে আওয়ামী ঘরানা এবং দিল্লি মস্কোওয়ালারা যখন রবীন্দ্রনাথকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেন, যখন ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করেন তখন ওরা নিজেদের অজান্তেই রবীন্দ্রনাথকে তীব্র বিতর্কের সাবজেক্ট করে তোলেন। রবীন্দ্রনাথের মরমি সঙ্গীত, প্রকৃতি সব কিছু ছাপিয়ে তখন সামনে আসে একই কবির শিবাজি উৎসব কবিতা। যেখানে বলা হয়েছে-

মারাঠির সাথে আজি,

হে বাঙালি, এক কণ্ঠে বলো

রবীন্দ্রনাথকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা শুরু হয়েছে ১৯৬১ সাল থেকে, যখন মহাসমারোহে সেদিনের পূর্বপাকিস্তানে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপন করা হয়। রাজনৈতিক বই

বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন বিভক্ত হয়। বিভক্তির দুই প্রান্তেই ছিল চরমপন্থিরা। কিন্তু শহীদ জিয়া এবং বেগম জিয়ার আমলে এই দুই চরমপন্থার মধ্যে এক অপূর্ব মেলবন্ধন সৃষ্টি করা হয়। সেই মেলবন্ধনে যেমন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তেমনি ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম এবং ফররুখ আহমেদ। ওরা করে জয়বাংলা সাংস্কৃতিক জোট, আর বিএনপি করে জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক জোট। উদ্যোগটি ভালো ছিল। কিন্তু শুধু, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ/জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ’, গানটি দিয়েই কি ওদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে মোকাবিলা করা যাবে? বরং ওদেরকে মোকাবিলা করতে হলে ওপরের ওই গানটি ছাড়াও তুলে ধরতে হবে ৯২ শতাংশ মুসলমানের গান। যেমন-

এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,

তবু দেখা যায় দূরে বহু দূরেবাংলাদেশি পোশাক

হেরার রাজ-তোরণ,

এখানে এখন প্রবল ক্ষুধায়

মানুষ উঠছে কেঁপে,

এখানে এখন অজস্র ধারা

উঠছে দু’চোখ চেপে

তবু দেখা যায় দূরে বহু দূরে

হেরার রাজ-তোরণ।

আগামী দিনের রাষ্ট্রক্ষমতার অভিলাসী বিএনপিকে জানতে হবে বাংলাদেশের সমাজকে পরিপূর্ণভাবে। শুধু তাদের দলীয় কর্মীদেরকে গণনায় নিলেই হবে না। বিবেচনায় নিতে হবে জুলাই বিপ্লবোত্তর জনগণের পরিবর্তিত মমন। জুলাই বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন লাখো মাদরাসার ছাত্র। মসজিদে আজান দিয়ে মুসল্লিরা বেরিয়ে ছিলেন সেই গগনবিদারী স্লোগান দিয়ে ‘নারায়ে তাকবির/আল্লাহু আকবার।’

জিয়াউর রহমান সংবিধানে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর সাথে বৃহত্তর সংহতির অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। শেখ হাসিনা সেটি বাদ দিয়েছেন।

জিয়াউর রহমান শাহ আজিজুর রহমানসহ মুসলিম লীগ নেতাদেরকে যেমন বিএনপিতে নিয়েছিলেন, তেমনি মির্জা ফখরুলদের মতো পিকিংপন্থি বামদেরও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ২০১৮ সালে সেই বিএনপিকে দেখা যায়নি। তারা ড. কামাল হোসেনের মতো কট্টর মুজিববাদীকে ঐক্যজোটের প্রধান হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন।

আসন্ন নির্বাচনে বিএনপিকে যদি গণমানুষের সমর্থন নিতে হয় তাহলে নতুন সমাজের, পরিবর্তিত সমাজের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করতে হবে। শেখ মুজিবের মাত্রাতিরিক্ত বাঙালিপনার বিরুদ্ধে শহীদ জিয়ার আল্লাহর প্রতি আস্থা তাকে (জিয়াকে) প্রতিক্রিয়াশীল হিসেবে উপস্থাপিত করেনি; বরং তার জনপ্রিয়তা সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।

বর্তমান বিএনপিকে হৃদয়ের দুই অলিন্দে যুগপৎ দুটি বিশ্বাসকে ধারণ করতে হবে। আমরা যেমন মুসলমান তেমনি নৃতাত্ত্বিকভাবে বাঙালি। আমরা যেমন গাইব ‘জারি মুখে সারি গান/লা শারিক আল্লাহ’, তেমনি গাইব ‘চল চল চল/ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল।’ তেমনি গাইব-

আহা আজি এ বসন্তে

এত ফুল ফুটে

এত বাঁশি বাজে,

রাজনৈতিক বইবাংলাদেশি পোশাক
এত পাখি গায়।

Email : [email protected]