সমকালীন প্রসঙ্গঃ পিএসসির ফাঁস হওয়া প্রশ্নের আত্মকথন


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুলাই ১২, ২০২৪, ৮:৩১ অপরাহ্ণ /
সমকালীন প্রসঙ্গঃ পিএসসির ফাঁস হওয়া প্রশ্নের আত্মকথন
গোলাম মাওলা রনিঃ 

আজ অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আপনাদের আমার একান্ত কিছু গোপন কথা বলার জন্য হাজির হয়েছি। সম্প্রতি আমাকে নিয়ে সারা দেশে হইচই শুরু হয়েছে এবং আমার জনক-জননী ও আমার ঔরসজাত সন্তানদেরকে নিয়ে ভেতো বাঙালি অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে। বাঙালির গালি দেয়ার স্বভাব কমবেশি সবাই জানে।

তারা ওঝার বেশে গালাগাল দিয়ে সাপের বিষ পানি করার চেষ্টা চালায়। কেউ কেউ ভণ্ড পীর ফকির সেজে গালাগালির মাধ্যমে জিন-ভূত তাড়ানো থেকে শুরু করে স্বামী-স্ত্রীর মিল মহব্বত-বশীকরণ-বাণ মারা-জাদুটোনা মারা ইত্যাদি কুকর্ম অহরহ করে থাকে। সুতরাং যে গালাগালির কারণে জিন-ভূত পালিয়ে যায়- সাপের বিষ নেমে যায় কিংবা জাদুটোনার কবলে পড়ে অসম্ভব ঘটনা ঘটে যায়, সেই গালি যখন কোটি কোটি মানুষের মুখে উচ্চারিত হয়ে আমার জাত-গোষ্ঠী উদ্ধার করছে তখন আমার মনের অবস্থা কী হতে পারে তা বর্ণনা করার আগে আমার বংশপরিচয় নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক।

আমি বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের যে নিয়োগ পরীক্ষা হয় সেই পরীক্ষার ফাঁস হওয়া গর্বিত উচ্চবংশীয় মর্যাদাসম্পন্ন একটি প্রশ্নপত্র। আবেদ আলী নামের একজন ড্রাইভার যিনি আমার বিকল্প জনক, অর্থাৎ দু’নম্বরি পিতা হিসেবে ইতোমধ্যেই আপনাদের নিকট বেশ কুখ্যাতি পেয়েছেন তার কুকর্ম প্রকাশিত হওয়ার আগে আমি ছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে কাক্সিক্ষত বস্তু। আমার মূল্য ছিল অসীম। ১০ লাখ থেকে ১০ কোটি দিয়ে হলেও দুর্নীতিবাজদের রোলমডেলের চলমান ভার্সন এবং ভবিষ্যৎ ভার্সনরা আমাকে পাওয়ার জন্য আমার দু’নম্বরি পিতার পেছনে ফকির-মিসকিন, এতিম-অসহায়ের মতো ঘুরত। আমার দু’নম্বরি পিতা দয়া করে যাদের হাতে আমার একখানা ফটোকপি বিক্রি করতেন সেই পরিবারে খুশির বন্যা বয়ে যেত।

 আমার ফটোকপি যারা কিনত তারা প্রথমে আনন্দে লাফাত। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরত। বার বার চুমা খেত। নিজেদের গাল ও চোখের ওপর আমাকে চেপে ধরত কাক্সিক্ষত প্রিয়তমা অথবা প্রিয়তমের মতো। উত্তেজনায় রাতে ঘুমাতে পারত না। অনেকে আমার দু’নম্বরি পিতার কদমবুচি করত, তার বাসায় মিষ্টি পাঠাত এবং সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকার প্রতিজ্ঞা করত। এসব কারণে আমার মনে হতো, আমার মতো সৌভাগ্যের অধিকারী কোনো বস্তু পৃথিবীতে নেই। আমি সুযোগ পেলেই নিজেকে নিয়ে চিন্তা করতাম এবং বাংলাদেশে আমার কী প্রয়োজন তা নিয়ে গবেষণা করতাম। নিজের কার্যকারিতা এবং প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমি এমন কিছু নির্মম বাস্তবতা আবিষ্কার করেছিলাম, যা আপনাদেরকে না বলে থাকতে পারছি না।

আপনি যদি চলমান বাংলাদেশের নির্মম বাস্তবতা তালাশ করেন তবে প্রথমেই দেখবেন দুর্নীতির ছড়াছড়ি এবং আমাদের দেশে যেসব দুর্নীতি হচ্ছে তার ধরন প্রকৃতি খুবই নিম্নমানের। বহু আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ বলেছিলেন, এ দেশের ভিক্ষুকরাও দুর্নীতি করে। ড. হুমায়ুন আজাদ যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে হালফ্যাশনের দুর্নীতি দেখে বলতেন, দুর্নীতিবাজরা ভিক্ষুকদের চেয়েও নিম্নমানের মনমানসিকতা নিয়ে দুর্নীতি করে। এ দেশের দুর্নীতিবাজদের চরিত্রহীনতা ও বিকৃত রুচি দেখে পর্নোতারকা সানি লিয়ন বা মিয়াখলিফারা বমি করে দেয়। ভ্রাম্যমাণ পতিতারা মনে করে, তারা দুর্নীতিবাজদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। এমনকি নিকৃষ্ট পশু-পাখিদের জবান যদি খুলে দেয়া হতো তারা দুর্নীতিবাজদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিত এবং সুযোগ থাকলে সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাদের নির্মূল করার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করত।

সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতির বিস্তার ঘটলেও সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে এর প্রকোপ কলেরা, গুটিবসন্ত কিংবা প্লেগের মতো ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগকৃত ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার সার্ভিসের যেসব কুলাঙ্গার দুর্নীতিতে জড়ায় তাদের দেখলে ইবলিশ শয়তানও ভয়ে পালিয়ে যায়। অথচ সিভিল সার্ভিস যেখানে শুরু হয়েছিল কয়েক হাজার বছর আগে সেই চীন দেশে এখনো এই সার্ভিসের বিরুদ্ধে কোনো বদনাম নেই। এরকম ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিস এবং সেই পথ ধরে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস ও পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস আজো গৌরব ও ঐতিহ্য নিয়ে দেশ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অথচ উল্লিখিত তিনটি সার্ভিসের অপভ্রংশ হয়ে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস তো পাকিস্তান ও ভারতের থেকে বেশি সফলতা পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে এসে কেন পুরো সিস্টেম মুখ থুবড়ে পড়ল তা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে আমি অনেক কিছু আবিষ্কার করে ফেলি।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সিভিল সার্ভিসটি একজন বিশেষ ব্যক্তির নামে পরিচিতি পায়। ওই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যার নামে টোকেন ইস্যু করতেন সেই ব্যক্তিই সিভিল সার্ভিসের সদস্যরূপে নিয়োগ পেতেন। পরবর্তীকালে টোকেনের পরিবর্তে পরীক্ষাপদ্ধতি চালু হলেও ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের যে নীতিমালা তা অনুসরণ না করার কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হতদরিদ্র পরিবারের তথাকথিত ভালো ছাত্র হিসেবে মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী নারী-পুরুষরা পাইকারি হারে নিয়োগ লাভ করতে থাকে। এদের অভাব, হীনম্মন্যতা, মেধা ও যোগ্যতার সার্বিক সূচক নেতিবাচক হওয়া এবং দেশে বারবার গণতন্ত্রহীনতার কারণে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়। ফলে অভিজাত ও সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা সরকারি চাকরিবিমুখ হয়ে পড়েন।

দরিদ্র পরিবার থেকে ওঠে আসা লোকজন সিভিল সার্ভিস, পুলিশ সার্ভিসসহ অন্যান্য ক্যাডার বা নন-ক্যাডার সার্ভিসে যোগদান করে প্রথমেই নিজেদের চাঁদের দেশের মানুষ ভাবতে থাকে। তারা চাকরি জীবনের প্রথম কয়েক বছর এক্সট্রা ভার্জিন থাকার চেষ্টা করে। এই সময়ে তাদের অত্যাচার, ভুল সিদ্ধান্ত, খামখেয়ালি, হামবড়া ভাব ইত্যাদি কারণে ঘরে-বাইরে সব কিছু তছনছ করে ফেলে। অন্য দিকে, একটি অংশ চাকরি জীবনের প্রথম দিন থেকেই দুর্নীতি আরম্ভ করে দেয়। যারা এক্সট্রা ভার্জিন হওয়ার চেষ্টা করে তাদের একটি অংশ মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তারূপে পদোন্নতি লাভের পর রাক্ষসের মতো দুর্নীতি আরম্ভ করে। অপর অংশটি হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে পরিবার সমাজ সংসারের জন্য বোঝা হয়ে একের পর এক অনাসৃষ্টি তৈরি করতে থাকে।

যারা দুর্নীতিতে সিদ্ধি লাভ করে তাদের মধ্যে সবচেয়ে এলিট শ্রেণীটির উদাহরণ হলো বেনজীর-মতিউর। তার পরের শ্রেণীটি মেনি বিড়াল বা ভেজা বিড়ালের মতো থাকলেও সমাজ সংসারের জোঁকরূপে দেশ জাতির রক্ত খেয়ে পুরো জাতিকে দেউলিয়াত্বের দিকে নিয়ে যায়। অন্য দিকে, তৃতীয় আকেটি গ্রুপ রয়েছে যারা ভালো-মন্দের ভারসাম্য ঘটিয়ে নিজেদের দুর্নীতিকে রীতিমতো শৈল্পিক মর্যাদা দিয়ে আশপাশের মানুষকে বোকা বানিয়ে উঠতি ভদ্রলোক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় এবং পরবর্তী প্রজন্মকে নিজেদের উত্তরসূরিরূপে সিভিল সার্ভিসে ঢোকানোর চেষ্টা করে।

আমার জন্মের কার্যকারিতা সাধারণত তৃতীয় গ্রুপটির কাছে প্রকট আকার ধারণ করে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর দুর্নীতিবাজদের ছেলে-মেয়ে অমানুষ হয়ে যায়। অনেকের পরিবার ভেঙে যায়- কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি দিয়ে বেগমপাড়ার বাসিন্দা হয়ে যায়। অন্য দিকে, তৃতীয় গ্রুপটি কৌশলে দুর্নীতি করে অঢেল অর্থবিত্ত, মান-সম্মান ও প্রভাব-প্রতিপত্তির মালিক হয়ে যায়। তারা নিজেদের রেখে আসা দুর্নীতির স্বর্ণের খনিতে তাদের ঔরসজাত সন্তানদের নিয়োগদানের জন্য পাগলপারা হয়ে পড়ে এবং কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে হলেও ফাঁসকৃত প্রশ্নের একটি ফটোকপি লাভের জন্য আমার দু’নম্বরি পিতা আবেদ আলীর চরণ মোবারকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারা আবেদ আলীর জুতা টানা থেকে শুরু করে অন্য যেকোনো ফুট ফরমাশ খাটার জন্য আবেদ আলীর বাড়ির দরজায় ধরনা দিতে থাকে।

উল্লিখিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি আমার জন্মের সফলতা নিয়ে বেশ আহ্লাদিত ছিলাম। কারণ যারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে আমাকে কিনত তারা কেউই আমার সাথে সাদেক অ্যাগ্রোর পশুর মতো আচরণ করত না; অর্থাৎ বহুমূল্য দিয়ে কিনে আমাকে কোরবানি দিত না; বরং তারা আমাকে নিজেদের জান-কলিজা-গুর্দা-চোখের মণির মতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করত এবং আদর সোহাগে আমার জীবন ভরিয়ে দিত। কিন্তু সম্প্রতি আবেদ আলীসহ মোট ১৭ জন প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীর নাম সামনে চলে আসায় আমি রীতিমতো অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছি। আমার ভয় হচ্ছে, আরো কতজন প্রশ্ন ফাঁসকারী ধরা খাওয়ার পর্যায়ে রয়েছে এবং বিগত দিনে এ কাজে কত হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে সেই তথ্য- কবে বের হবে। আবেদ আলীর গডফাদারদের নাম যদি ফাঁস হয় এবং যারা আমাকে ক্রয় করে ভুয়া পরীক্ষায় ভুয়া পাস করে বড় বড় পদে বসে আছে তারা যদি ধরা খায় তবে আমার কী হবে?

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য