সম্পাদকীয়- স্লোগানে স্লোগানে আন্দোলন, আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থান


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৪, ৭:২২ পূর্বাহ্ণ /
সম্পাদকীয়- স্লোগানে স্লোগানে আন্দোলন, আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থান

যুগে যুগে গণমানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়য়ের জন্য সংঘটিত হয়েছে অসংখ্য আন্দোলন। হয়েছে মিছিল ও সমাবেশ। আর এতে উচ্চারিত হয়েছে নানাবিধ হৃদয়স্পর্শী স্লোগান। লাখো জনতার সমর্থন আদায়ে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে স্লোগান। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জনতাকে করে ঐক্যবদ্ধ, দাবীসমূহকে জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক দাবিতে রূপান্তরিত করে। সে সূত্রে আন্দোলন ও স্লোগান শব্দদ্বয় অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। মূলত স্লোগান একটি ইংরেজি শব্দ; যা কতগুলো নীতি বাক্যের সমষ্টি। উইকিপিডিয়া বলছে, স্লোগান একটি ধারণা বা উদ্দেশ্য পুনরাবৃত্তিমূলক অভিব্যক্তি হিসেবে একটি রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, ধর্মীয় এবং অন্যান্য প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত কতগুলো স্মরণীয় নীতিবাক্য বা শব্দগুচ্ছ। আরো সহজভাবে বললে দাঁড়ায়, স্লোগান হচ্ছে একটি শক্তিশালী এবং আকর্ষণীয় শব্দ, বাক্য বা বাক্যাংশ; যা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধনের জন্য রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, ধর্মীয় প্রভৃতি প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করা হয়।

আলোচ্য সম্পাদকীয় নিবন্ধে একটি আন্দোলনের গতি পরিবর্তনের সাথে সাথে স্লোগানের যে বিবর্তন ঘটে এবং সেক্ষেত্রে স্লোগানের শব্দচয়ন, ভাষার প্রখরতা, বাক্যের ব্যবহারের মাধ্যমে কিভাবে একটি আন্দোলনকে গণঅভ্যূত্থান বা গণ আন্দোলনে রূপান্তরিত করে তা ফুটে উঠবে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা পূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মোট পাঁচটি গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সাধারণ জনগোষ্ঠীর অংশগণমূলক অভ্যুত্থান হচ্ছে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বা গণবিপ্লব। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোন কোটা থাকবে না বলে ঘোষণা দিয়ে একটি পরিপত্র জারি করলে, তা ২০২৪ সালের আন্দোলন আগে পর্যন্ত বহাল ছিল। কিন্তু বিপত্তি ঘটে হাইকোর্ট কর্তৃক ওই পরিপত্রটি বাতিল ঘোষণার মাধ্যমে।

ফলে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে ১ জুলাই থেকে আন্দোলনে নামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্রথম ১৪ দিন আন্দোলন শুধুমাত্র মিছিল, গণজমায়েত, স্মারকলিপি প্রদান ইত্যাদি কর্মসূচির মাধ্যমে অহিংস থাকলে ও সময়ের পরিক্রমায় তা সহিংস হয়ে উঠে। আর এ অহিংস আন্দোলনের সময় যেসব স্লোগান আন্দোলনকারীদের মুখে উচ্চারিত হয়েছে, ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে প্রেরণা জুগিয়েছে তা হলো- ‘কোটা না মেধা? মেধা, মেধা।’ `দফা এক, দাবি এক, কোটা নট কাম ব্যাক’ ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাই নাই’ ‘Justice, Justice, We Want Justice.’ এছাড়াও, এ অহিংস আন্দোলনে আরো কিছু ইতিহাস পুনরাবৃত্তিমূলক স্লোগান শোনা গেছে, যেমন- ‘আপস না সংগ্রাম? সংগ্রাম, সংগ্রাম।’ ‘দালালি না রাজপথ? রাজপথ, রাজপথ।’

’৫২-এর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।’ অহিংস আন্দোলন চলাকালীন শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দমন-পীড়ন, সশস্ত্র ও সহিংস হামলা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এ ছাড়াও, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই চীন সফর উত্তর সংবাদ সম্মেলনের একপর্যায়ে বলেছিলেন, কোটা মুক্তিযুদ্ধাদের ছেলেমেয়ে ও নাতি-পুতিরা পাবে না তো রাজাকারের বাচ্চারা পাবে? মুক্তিযুদ্ধাদের সন্তান-নাতিপুতিরা কি মেধাবী না; যত রাজাকারের বাচ্চা-নাতিপুতিরা মেধাবী? প্রধানমন্ত্রীর এ ধরণের ঔদ্বত্যপূর্ণ বক্তব্য ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ঘি ঢেলে দেয়। এসময় তাদের আন্দোলনে যোগ হয় ভিন্ন মাত্রা; স্লোগানে আসে কিছু পরিবর্তন। যেমন- ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার; হয়ে গেলাম রাজাকার, চেয়েছিলাম অধিকার।’

১৫ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে এবং রাজপথে কিছু মনোক্ষুদ্ধমূলক স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে- ‘আমি কে? তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার, কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’ ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক।’ ‘হলে হলে খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে, সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে।’ ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠে। ঘোষিত হয় বাংলা ’ব্লকেডের’ মতো অভিনব কর্মসূচি। এ দিন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাঈদ, চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী মোঃ ওয়াসিম আকরাম, ফয়সাল আহমেদ শান্ত এবং মোঃ ফারুক পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের মুহুর্মুহু গুলি ও অতর্কিত হামলায় নিহত হলে স্ফুলিঙ্গের মতো আন্দোলন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ছাত্র-জনতা ও আন্দোলনকারীদের স্লোগানের ভাষা ছিল এ রকম- ‘লাশের ভেতর জীবন দে, নইলে গদি ছাইড়া দে, বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’ পুলিশ কর্তৃক আন্দোলনে বাধা প্রদান করা হলে ঠাকুরগাঁয়ের নারী শিক্ষার্থীরা এসময় পুলশিকে উদ্দেশ্য করে স্লোগান দেয়- ‘কে এসেছে? কে এসেছে? পুলিশ এসেছে, পুলিশ এসেছে, কি করছে? কি করছে? স্বৈরাচারের পা চাটছে।’

১৭-২০ জুলাইয়ের মধ্যে শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারী জনতার উপর নির্মমতা বাড়তে থাকে। আওয়ামী সন্ত্রাসী, পুলিশ ও বিজিবি বৃষ্টির মত তাজা গুলি ছুড়লে শত-শত আন্দোলনকারী শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা পান করতে থাকে। এসয় রাজপথের স্লোগান আরো ঝাঁঝালো হয়ে উঠে- ‘ক্ষমতা না জনতা? জনতা, জনতা।’ ‘খুনি হাসিনার কালো হাত, জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও।’ ‘লেগেছে রে, লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে।’ ‘আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’ এক পর্যায়ে সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে কারফিউ জারি করে দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে এবং বিভিন্ন ধরণের মিথ্যাচারের আশ্রয় নিতে থাকে আর নামী-বেনামী মামলা দায়ের করার মধ্য দিয়ে ছাত্র জনতাকে পাইকারি দরে গ্রেফতার করতে থাকে। এহেন নির্মমতা, গণগ্রেফতার ও রিমান্ডের ফলে দেশের আপামর জনসাধারনের অন্তর কেঁপে উঠে; ফলে দলে দলে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ায় নানা পেশার মানুষ। এ সময় আন্দোলন নতুন রূপ পায়।

স্লোগানে স্লোগানে শহীদদের স্মরণ করার পাশাপাশি সরকারের কাছে জবাব চাওয়া হয়- ‘আবু সাঈদের স্মরণে, ভয় করি না মরণে।’ ‘শহীদদের স্মরণে, ভয় করি না মরণে।’ ‘আমার ভাই মরলো কেন? খুনি হাসিনা জবাব দে; বিচার বিচার বিচার চাই, খুনি হাসিনার বিচার চাই।’ ৩ আগস্ট এক দফার দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য অসহযোগ আন্দেোলনের ঘোষনা দেয় ’বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। তথনকার স্লোগানের সুর ক্ষমতার মসনদে কুঠারাঘাত করতে থাকে। আন্দোলন কারীরা বলতে থাকে- ‘এক-দুই-তিন-চার, খুনি হাসিনা গদি ছাড়।’ ‘দফা এক, দাবি এক, খুনি হাসিনার পদত্যাগ।’ ‘খুনি হাসিনার পতনে, ভয় করিনা মরণে।’ ৪ আগস্ট বিকেল বেলা লাখো জনতার উপস্থিতিতে ’বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ নেতৃবৃন্দ জাতীয় শহীদ মিনারের পাদদেশ থেকে ঘোষণা করেন ‘মার্চ টু ঢাকা’। সারা বাংলাদেশ থেকে আপামর জনসাধারণকে ৫ তারিখ দুপুর ২টায় ঢাকা আসার আহ্বান জানান এক দফার দাবিতে গণভবন ঘেরাও করার। সে হিসেবে ঢাকার আশেপাশের আন্দোলনকারী ও সাধারণ জনতা ভোর রাত থেকে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে দেয় মিছিলে মিছিলে। সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হতে থাকে- ‘জ্বালো রে জ্বালো, আগুন জ্বালো; স্বৈরতন্ত্রের কালো হাত, জ্বলিয়ে দাও, গুড়িয়ে দাও। ঘেরাও ঘেরাও ঘেরাও হবে, গনভবন ঘেরাও হবে।’

লক্ষ লক্ষ জনতার ঢাকায় প্রবেশ এবং আওয়ামী সন্ত্রাসী ও আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দমন-পীড়ন ও নির্বিচারে গুলিবর্ষণের ফলে শহীদের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৫ শতাধিক, পরবর্তীতে এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে ৮ শতের ঘরে গিয়ে দাঁড়ায়। আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করেন ১০ সহস্রাধিক ছাত্র জনতা। এতদসত্ত্বেও জনগনকে দমাতে না পেরে শত-সহস্র চেষ্টার পর দুপুর ২টার কিছু পরে খুনি হাসিনা পদত্যাগ করে গনভবন ছেড়ে ভারতের উদ্দেশে রাওনা দেন। এ খবর সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়লে উৎসুক জনতা দলে দলে রাজপথ প্রকম্পিত করে মিছিলে মিছিলে- ‘ছি! ছি! ‍ছি! হাসিনা, লজ্জায় বাঁচি না; পালাইছে রে পালাইছে, খুনি হাসিনা পালাইছে।’ ‘দিয়েছি তো রক্ত আরো দেব রক্ত, রক্তের বন্যায় ভেসে যাবে যাবে অন্যায়; ফাঁসি ফাঁসি; ফাঁসি চাই, খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই।’

এভাবে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ছিল ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার ও সময়ের পরিক্রমায় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। আর এসব স্লোগানের ভাষা ও আবেদন নাড়া দিয়েছিল ১৮ কোটি বনি আদমের হৃদয়। আর খুনি, দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরাচারী হাসনিার পদত্যাগ ও তৎপরবর্তী দেশত্যাগ এবং তার দোষরদের আত্মগোপনের মধ্য দিয়ে রচিত হয় সাড়ে ১৫ বছরের জুলুম-নির্যাতনের কবর; সেই সাথে উদিত হয় পূব দিগন্তে আরেকটি স্বাধীনতা সূর্য। যার নাম ‘২৪-এর গণঅভ্যূত্থান’ বা ‘জুলাই বিপ্লব’।