গত প্রায় এক দশকে দেশে গ্যাসের সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। এ সংকট প্রতিনিয়তই বাড়ছে। প্রকৃত চাহিদার বিপরীতে অর্ধেক গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে নানা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে। অভ্যন্তরীণ জোগান কমে আসা এবং আর্থিক সংকটের কারণে পর্যাপ্ত এলএনজি আমদানি করতে না পারায় এই সংকট চলছে।
গ্যাসের সংকটে একদিকে বিনিয়োগ প্রায় স্থবির হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে, শিল্প কারখানা একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আরও বেশি পরিমাণ গ্যাস উত্তোলনের লক্ষ্যে চলমান প্রকল্পের বাইরে আরও ১০০টি কূপ খননের উদ্যোগ নিয়েছে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নেওয়া পরিকল্পনার সঙ্গে আরও বেশি অনুসন্ধানের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকারও। কারণ, সব বিশেষজ্ঞরাই বলছেন সারা দেশে ব্যাপক হারে গ্যাসের অনুসন্ধান কূপ খনন করা উচিত। যদিও কোথাও একটা বড় গ্যাস ক্ষেত্র পাওয়া যায়, তবে বাংলাদেশ ভবিষৎ জ¦ালানি সংকট থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাবে।
সাম্প্রতিক সময়ে পেট্রোবাংলা থেকে জ¦ালানি বিভাগে জমা দেওয়া এক পরিকল্পনায় দেখা যায়, বিদ্যমান ৫০টি কূপ খনন ও ১০০টি কূপ ওয়ার্কওভার কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ১৮টি প্রকল্পের আওতায় ৫০টি কূপ খননের মধ্যে পাঁচটি কূপ খনন শেষ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৩০টি কূপ খনন পরিকল্পনার মধ্যে ৯টি কূপ খনন প্রকল্প চলমান আছে।
আরও ৩৯টি কূপ খনন কাজের অনুমোদিত হয়ে আছে। সেগুলোর মধ্যে ১৪টি নিয়ে কাজ করছে বাপেক্স। পরিকল্পনায় দেখানো হয়েছে, এ পর্যন্ত ১৬টি কূপের কাজ শেষ হয়েছে, সেখান থেকে ১৮৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সন্ধান মিলেছে। তাতে জাতীয় গ্রিডে ৭২ এমএমসিএফডি যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া নতুন করে আরও ১০০ কূপ খনন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬৯টি হবে অনুসন্ধান কূপ এবং ৩১টি হবে ওয়ার্কওভার কূপ।
পেট্রোবাংলা তাদের পরিকল্পনায় দেখিয়েছে, ৬৯টি কূপ যদি ঠিকমতো খনন হয়, তাতে সম্ভাব্য দৈনিক গ্যাসের উৎপাদন হবে ৯৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। আর ৩১টি কূপের ওয়ার্কওভার করতে পারলে উৎপাদন বাড়বে ২১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ১৫টি প্রকল্পের অধীনে ৬৯টি কূপ খনন করা হবে।
১০০ কূপের আর্থিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পেট্রোবাংলা দেখিয়েছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় করা হবে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল ২ হাজার ৩২০ কোটি এবং গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে ৯৮০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ২০২৬-২৭ অর্থ বছরে খরচ হবে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ২০২৭-২৮ অর্থ বছরে খরচ হবে ৫ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা, ২০২৮-২৯ অর্থ বছরে খরচ হবে ৬ হাজার কোটি টাকা। পুরো টাকার মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ হবে ১৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। আর গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে খবর হবে ৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
জ্বালানী বিভাগ সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় উৎস থেকে গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে ২০২৬-২৯ সালের মধ্যে স্থলভাগে ১০০ কূপ খননের পরিকল্পনা পেট্রোবাংলার। এর মধ্যে অধিকাংশই ছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের। অন্তর্বর্তী সরকার এসে প্রথমে এ প্রকল্পগুলো বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তবে নানা বিচার বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দেশ উপকৃত হবে। পরে পূর্বের পরিকল্পনার সঙ্গে নতুন করে আরও অনুসন্ধান কূপ খননের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
সূত্রে জানা যায়, গ্যাস উত্তোলনে নিয়োজিত তিনটি বিতরণ কোম্পানির আওতায় এসব গ্যাসকূপ খনন করা হবে। এর মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) একাই ৬৯টি কূপে খনন করবে।
দেশে গ্যাসের প্রকৃত চাহিদা রয়েছে ৫ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। যদিও জাতীয় গ্রিডে পেট্রোবাংলার গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে দেশে গ্যাসের বিশাল পরিমাণ ঘাটতি থাকছে। এ ঘাটতি মেটাতে এবং আমদানিনির্ভরতা কমাতে স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দিয়েছে সরকারের।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, বাপেক্স একাই ৬৯টি কূপ খননের মাধ্যমে জাতীয় গ্রিডে ২০২৯ সাল নাগাদ দৈনিক আরও ৯৮৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জোগান বাড়ানো যাবে। বাকি ৩১টি কূপ খনন করবে গ্যাস উত্তোলন কোম্পানি বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (বিজিএফসিএল) ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল)।
এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার একজন জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, এখন উচিত দেশের প্রতিটি প্রান্তে দ্বি-মাত্রিক ও তৃমাত্রিক জরিপ পরিচালনা করে সম্ভাব্য জায়গাগুলোয় প্রচুর পরিমাণ কূপ খনন করা। তিনি বলেন, আমাদের যে সংকট তাতে কূপ খনন করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ কর্মকর্তা বলেন, আমাদের ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ এলাকায় গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।