সাবেক চার এমপি’র বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানঃ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা লুট


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : আগস্ট ১৯, ২০২৪, ৯:০৬ পূর্বাহ্ণ /
সাবেক চার এমপি’র বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানঃ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকা লুট

সিন্ডিকেট করে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর নামে চারটি প্রতিষ্ঠানের ২৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা পড়েছে বেশ আগে। কিন্তু যাচাই-বাছাইয়ের নামে দুদক এতোদিন অভিযোগটি ধামাচাপা দিয়ে রাখে। কারণ, সিন্ডিকেটে রয়েছে সদ্য উৎখাত আওয়ামীলীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরপরই শ্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে সেই চক্রের বিরুদ্ধে নড়েচড়ে বসে দুদক। কমিশনের সিনিয়র কর্মকর্তাদের অনেকে মনে করেন, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সংস্থাটির বর্তমান কমিশনেরও বিদায় ঘন্টা বেজে ওঠে। তা সত্ত্বেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে তুষ্ট করতেই দুদক এখন কিছু দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে ‘কাজ’ করতে শুরু করেছে।

বিনা আবেদনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা প্রত্যাহারসহ আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের কিছু দৃষ্টান্ত রাখতে শুরু করে এ সরকারের সামনে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগ সরকারের মাফিয়া এমপি ফেনী-২ আসনের নিজামউদ্দিন হাজারী, ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলব ও আওয়ামীকরুণা প্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদউদ্দিন চৌধুরী, ঢাকা-২০ আসনের সাবেক এমপি বেনজীর আহমেদ এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামাল, মেয়ে নাফিসা কামাল এবং তাদের সহযোগিদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক।

এ লক্ষ্যে উপ-পরিচালক মো: নূরুল হুদার নেতৃত্বে ৩ সদস্য বিশিষ্ট টিম গঠন করেছে সংস্থাটি। মূলত: মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চক্রে ঢুকে চার সাবেক এমপি’র রমরমা বাণিজ্য, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার ধ্বংস, শ্রমিকদের কাছ থেকে প্রতারণামূলকভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়া ইত্যাদি অভিযোগ সম্বলিত আবেদনের অনুসন্ধান করবে এ টিম।

উল্লেখিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অভিযোগ পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফেনী থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী বিদেশে কর্মী পাঠাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ‘স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেড’ নামে রিক্রটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেন। লাইসেন্স প্রাপ্তির সাড়ে তিন বছরে মাত্র ১০০ কর্মী বিদেশে পাঠান তিনি। ‘মালয়েশিয়া সিন্ডিকেটে’ বা চক্রে যোগ দেয়ার পর গত দেড় বছরে দেশটিতে অন্তত: ৮ হাজার কর্মী গেছেন নিজাম হাজারীর এজেন্সির মাধ্যমে। মালয়েশিয়ায় সবচেয়ে বেশি কর্মী পাঠানো এজেন্সির তালিকায় ৪ নম্বরে রয়েছে ‘স্নিগ্ধা ওভারসিজ।’

ফেনী-৩ আসনের সাবেক এমপি লে: জে: (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী ২০১৫ সালে ‘ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি রিক্রুটিং এজেন্সির লাইসেন্স নেন। মালয়েশিয়ায় এককভাবে শ্রমিক পাঠানোর শীর্ষে রয়েছে ফাইভ এম ইন্টারন্যাশনাল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি মধ্যপ্রাচ্যে আড়াই হাজারের মতো কর্মী পাঠিয়েছে। তবে মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে এই এজেন্সি একাই ছাড়পত্র নিয়েছে ৮ হাজার ৫৯২ কর্মীর।

ঢাকা-২০ আসনের সা্েক এটি বেনজীর আহমেদের প্রতিষ্ঠান ‘আহমেদ ইন্টারন্যাশনাল’ মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানোর দিক দিয়ে পঞ্চম অবস্থান রয়েছে। মালয়েশিয়ায় শ্রমবাজার খোলার আগে তাদের তেমন কোনো কার্যক্রম ছিল না। বিদেশে পাঠিয়েছিল মাত্র ২৩৮ কর্মী। তবে মালয়েশিয়া চক্রে ঢুকে তারা শীর্ষ তালিকায় চলে যায়। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় গেছেন ৭ হাজার ৮৪৯ কর্মী। সিন্ডিকেট গঠনের সময় বেনজীর ছিলেন রিক্রটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি।

সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামালের ‘অরবিটালস এন্টারপ্রাইজ’ ও মেয়ে নাফিসা কামালের ‘অরবিটালস ইন্টারন্যাশনাল’র নামে মালয়েশিয়ায় গেছেন ৯ হাজার ৮৬১ জন। সিন্ডিকেট করার সময় আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী ছিলেন।
তিন সাবেক এমপি ও একজন সংসদ সদস্যের পরিবারের সদস্যের এজেন্সির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ নেতা, সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর এবং এ খাতের নতুন অনেক প্রতিষ্ঠান বিপুল সংখ্যক কর্মী পাঠাচ্ছে।

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশ কর্মী পাঠায়। তবে বাংলাদেশ ছাড়া কোনও দেশে এমন চক্র-ব্যবস্থা নেই। চক্রের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও জড়িত। চক্রে থাকা এজেন্সিগুলো বসে বসে প্রতি কর্মীর বিপরীতে অন্তত: দেড় লাখ টাকা ‘চক্র ফি’ পাচ্ছে। অন্যান্য এজেন্সির মধ্যে অন্যতম হলো- ঐশী ইন্টারন্যাশনাল, নিউএজ ইন্টারন্যাশনাল, ক্যাথারসিস ইন্টারন্যাশনাল, বিএনএস ওভারসিজ লিমিটেড, পিআর ওভারসিজ, সাদিয়া ইন্টারন্যাশনাল, ইম্পেরিয়াল ওভারসিজ, বিএম ট্রাভেলস লিমিটেড এবং অপূর্ব রিক্রুটিং এজেন্সি।

অভিযোগের তথ্য মতে, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার-নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা। কিন্তু মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশীকর্মী খরচ করেছেন ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। দেড় বছরে সাড়ে ৪ লাখের মতো লোক পাঠিয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে এ খাতে। সরকার নির্ধারিত ফি-এর চেয়ে বেশি নেয়া হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জনপ্রতি দেড় লাখ টাকা করে ‘চক্র ফি’ নেয়য়া হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।