ঢাকায় স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়নের অস্ত্রের বর্ণনা দিয়ে ফেসবুকে লাইভ করেছিলেন পুলিশ সুপার শাহের ফেরদৌস রানা। ২০২০ সালের ২৯ আগস্টের সেই ঘটনায় ২০২৪ সালে চাকরিচ্যুত হন তিনি। পুলিশের পোশাক পরে আপত্তিকর ভিডিও কনটেন্ট তৈরি করে টিকটকে আপলোড করার অভিযোগে ডিএমপির ১৩ কনস্টেবলের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। কিন্তু শাস্তি বা মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হলেও সামাজিক মাধ্যমে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা ভিডিওর প্রচার থেমে থাকেনি।
কোনো কোনো পুলিশ সদস্য সামাজিক মাধ্যমে যেমন আত্মপ্রচারণা করছেন, তেমনি রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং সমসাময়িক ঘটনাবলির ওপর বিতর্কিত মন্তব্যও পোস্ট করছেন। এ ধরনের প্রচার বা মন্তব্যের লাগাম টানতে পুলিশ সদর দপ্তর গত সপ্তাহে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, সামাজিক মাধ্যম ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুলিশে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। এখন থেকে ইউনিফর্ম পরা ব্যক্তিগত ভিডিও ও ছবি সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করতে পারবেন না পুলিশ সদস্যরা। ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার করলেও পড়তে হবে শাস্তির মুখে। অস্ত্রাগার ও অভিযানের সময়কার ভিডিও-ছবি প্রচারে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। টিকটক ও লাইকির মতো সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে পুলিশকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। নির্দেশনা অমান্য করলে পড়তে হবে বিভাগীয় শাস্তির মুখে।
এমনকি চাকরির ঝুঁকিতেও পড়তে হতে পারে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে কী করা যাবে, কী করা যাবে না- এ নিয়ে গত সপ্তাহে ‘বাংলাদেশ পুলিশের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা-২০২৫’ জারি করা হয়েছে। এর আগে সামাজিক মাধ্যম ও ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে ২০২২ সালে একটি নির্দেশিকা জারি করা হয়। গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার পালাবদলের পর আগের নির্দেশিকাটি সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন ও সময়োপযোগী করে গত ১৬ এপ্রিল নতুন নির্দেশিকা জারি করেছেন পুলিশপ্রধান বাহারুল আলম। ইতোমধ্যে নির্দেশিকাটি পুলিশের সব ইউনিটে পাঠিয়ে তা প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে প্রতিপালন ও অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে এমন কিছু করা যাবে না, যাতে রাষ্ট্র, সরকার বা বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। জাতীয় ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থি কোনো পোস্ট দেওয়া যাবে না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা ধর্মনিরপেক্ষতা পরিপন্থি কর্মকা- করা যাবে না। রাজনৈতিক মতাদর্শ, জঙ্গি কর্মকা- অথবা ধর্মীয় উগ্রবাদ সংশ্লিষ্ট কোনো মন্তব্য বা কনটেন্ট আপলোড করা যাবে না। জনমনে অসন্তোষ বা অপ্রীতিকর মনোভাব সৃষ্টি করতে পারে- এমন কোনো বিষয় লেখা, অডিও বা ভিডিও প্রকাশ করা যাবে না। চিহ্নিত, অভ্যাসগত অপরাধী বা এ রূপ কোনো বিতর্কিত কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তোলা ও পোস্ট করা যাবে না। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনো সার্ভিসকে হেয়প্রতিপন্ন করে এমন কোনো পোস্ট, কমেন্ট, লাইক, ইমোজি, শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
এ নির্দেশিকায় সামাজিক মাধ্যমের আওতায় ব্লগ, মাইক্রোব্লগস, ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাস, স্কাইপে, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল, ইউটিউব, উইচ্যাট, ইনস্টাগ্রাম, ম্যাসেঞ্জার ও ইমোর কথা উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ পুলিশের ইউনিট প্রধানগণ অথবা তার মনোনীত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজ নিজ ইউনিটে কর্মরত সব পুলিশ ও নন-পুলিশ সদস্য এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগকৃত সদস্য কর্তৃক ‘বাংলাদেশ পুলিশের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা-২০২৫’ যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে কিনা তা নিয়মিতভাবে মনিটর করতে বলেছে পুলিশ সদর দপ্তর। নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে সরকারি অ্যাকাউন্টে প্রদত্ত কনটেন্ট কিংবা কমেন্ট বাহিনী অথবা বাহিনীসংশ্লিষ্ট ইউনিটের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। নিজস্ব পোস্টে কনটেন্ট ও কমেন্টের ক্ষেত্রে যথার্থ ও নির্ভরযোগ্য হতে হবে। স্পর্শকাতর কনটেন্ট ও কমেন্ট সচেতনভাবে পরিহার করতে হবে। কনটেন্ট ও ফ্রেন্ড বাছাইয়ে সতর্কতা অবলম্বন এবং অপ্রয়োজনীয় ট্যাগ, রেফারেন্স বা শেয়ারিং পরিহার করতেও বলা হয়েছে।
নির্দেশিকায় বলা হয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ইউনিটপ্রধানের অনুমতি ছাড়া তদন্তাধীন বা বিচারাধীন বিষয়ে কোনো ভিডিও, স্থিরচিত্র, অডিও বা তথ্যাদি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে মোবাইল ফোন ও ক্যামেরার যথেচ্ছ অপারেশনাল কার্যক্রমের ভিডিও, স্থিরচিত্র বা অডিও ধারণ করা যাবে না। কর্তব্যরত অবস্থায় সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করলে সেটি কর্তব্যে অবহেলার শামিল ও অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে।
নতুন নির্দেশিকার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, সামাজিক মাধ্যম কীভাবে ব্যবহার করা যাবে, এ নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কিছু নির্দেশনা রয়েছে। সেই আলোকেই নতুন নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে বেশ কিছু ঝুঁকি রয়েছে। কোনো পুলিশ সদস্য যেন পেশাগত ঝুঁকির মধ্যে না পড়েন- এ বিষয়ে সচেতন থাকতেই এ নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া কোনো পুলিশ সদস্য যেন এমন কিছু শেয়ার না করেন, যাতে পুলিশ বাহিনী, নিজের ব্যক্তিগত জীবন ও পেশাগত ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে। এ জন্য সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সব পুলিশ সদস্যকে নির্দেশিকা প্রতিপালনের অনুরোধ করা হয়েছে। এআইজি আরও বলেন, পুলিশের ইউনিফর্ম পরে যখন কোনো পুলিশ সদস্য সামাজিক মাধ্যমে কোনো কিছু শেয়ার করেন, তখন তিনি বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন। তিনি যদি পোশাক পরে আপত্তিকর কিছু শেয়ার করেন, তাহলে তিনি নিজের এবং বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবেন। এ ধরনের কর্মকা- থেকে বিরত বা সচেতন থাকতেই নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে।
যেভাবে নজরদারি: পুলিশের ইউনিটপ্রধানরা সামাজিক মাধ্যমের তথ্য সংরক্ষণ ও নিয়মিত মনিটর করবেন। পুলিশের প্রত্যেকটি ইউনিটেই সাইবার নিরাপত্তা টিম কাজ করে। প্রতিটি ইউনিটে একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে সামাজিক মাধ্যম মনিটর করা হবে। কেউ এর ব্যত্যয় করলে সেটির স্ক্রিনশট ও ডিভাইস ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে পাঠানো হবে। কোনো পুলিশ সদস্য গাইডলাইন ভঙ্গ করলে তিনি যে-ই হোন না কেন, তদন্ত করে যাতে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অপরাধ অনুযায়ী পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও প্রয়োজন হলে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনবোধে সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিংয়ের সক্ষমতা রয়েছে এ রকম ইউনিটের (এসবি, সিআইডি, ডিএমপি, র্যাব, এটিইউ, বাংলাদেশ পুলিশের অন্য কোনো বিশেষায়িত ইউনিট, প্রশিক্ষিত পুলিশ কর্মকর্তা) সহায়তা গ্রহণ করা হবে।
মোবাইল-সিম ব্যবহারে নির্দেশনা: গুরুত্বপূর্ণ পেশাগত তথ্যাদি অননুমোদিত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করা যাবে না। সরকারি ফোন থেকে ব্যক্তিগত যোগাযোগ করা যাবে না। শুধু নিজের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম ব্যবহার করতে হবে। হারানো বা নষ্ট সিম চূড়ান্তভাবে অচল ও অকার্যকর করে একই নম্বরের বা ভিন্ন নম্বরের নতুন সিম ক্রয় করা যাবে। বাহিনীর জন্য বরাদ্দকৃত নম্বরের সিমকার্ড হারানো গেলে বা নষ্ট হলে অবশ্যই একই নম্বরের নতুন সিম উত্তোলন করতে হবে। ব্যক্তিগত বা অফিশিয়াল মোবাইলে জিপিএস বা লোকেশন সার্ভিস ইত্যাদি অন/চালু রাখা যাবে না। কারণ জিপিএস বা লোকেশন সার্ভিস অন/চালু রাখা হলে সংশ্লিষ্ট অফিসারের অবস্থান দুষ্কৃতকারী কর্তৃক ট্র্যাক করা সম্ভব হতে পারে। সুত্র: আমাদের সময়
আপনার মতামত লিখুন :