প্রতীকী ছবি
অপরাধীরা হয়ে উঠছে বেপরোয়া। একের পর এক নৃশংস ঘটনা জনমনে ভীতি সঞ্চার করেছে। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড, নারী ও শিশু নিপীড়ন এবং দলবদ্ধ হামলায় প্রশ্নবিদ্ধ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে সারাদেশে সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের নতুন তালিকা করার নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর। সব জেলার পুলিশ সুপার এবং ওসিদের এই তালিকা করতে বলা হয়েছে।
পাশাপাশি গতকাল রোববার রাত থেকে অভিযান জোরদার করা হয়েছে। এ অভিযানে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, দখলবাজ এবং নারী ও শিশু নিপীড়নকারীদের গ্রেপ্তার অগ্রাধিকার পাবে।
গতকাল সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, মব সৃষ্টি করে নৈরাজ্য এবং একের পর এক নৃশংসতার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেপ্তারে সারাদেশে ‘চিরুনি অভিযান’ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। চুরি, ছিনতাই, মব সহিংসতাসহ সব ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। অপরাধী অপরাধীই। সে যে দলেরই হোক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।
গতকাল রাতে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, চাঁদাবাজ, জবরদখলকারী, মাস্তানসহ সমাজে যারা অস্থিরতা তৈরি করছে, তাদের তালিকা হচ্ছে। কেউ বালুমহাল ও টেম্পোস্ট্যান্ড দখল করছে; চাঁদা আদায় করছে। অনেকে আইন হাতে তুলে নিতে চায়। নিজেরাই বিচার করতে চাচ্ছে। থানা ঘেরাও করে আসামি ছিনিয়ে নিচ্ছে। অনেকের মধ্যে অপ্রত্যাশিত আচরণ দেখা যাচ্ছে। তবে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আইনের মধ্যে থেকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ।
এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, যে বিশেষ অভিযানটি আগে থেকে চলমান, সেখানে পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তির অপতৎপরতা রোধ করাতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এখন যে অভিযান চলবে, সেখানে চাঁদাবাজ-দখলবাজদের আইনের আওতায় আনা হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা কীভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করবে– এটি জানতে তিনজন পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে। তারা বলছেন, সম্প্রতি চাঁদাবাজি, খুনোখুনি, ছিনতাই ও নারী এবং শিশু নিপীড়নের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এমন বাস্তবতায় চলমান যে বিশেষ অভিযান চলছে সেটি আরও জোরদার করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। যৌথ বাহিনী এই অভিযান চালাবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি ‘জয়েন্ট কো-অর্ডিনেশন সেন্টার’ রয়েছে। সেখান থেকে অভিযান সমন্বয় করা হবে।
গতকাল রাতে পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন্স) শাহজাদা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, সব ধরনের অপরাধীর নতুনভাবে তালিকা করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের অভিযান জোরদার করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এবারের অভিযানে চাঁদাবাজ, দখলবাজ ও নারী এবং শিশু নিপীড়নকারীদের আইনের আওতায় আনার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবে।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, কর্তৃপক্ষের শৈথিলতায় অপরাধীরা বেপরোয়া হচ্ছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেই ধরনের ভূমিকা পালন করতে না পারলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। বিশ্বাসযোগ্য ও সুনির্দিষ্ট তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অভিযান হলে তার ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তিনি।
গত বুধবার পুরান ঢাকায় মিটফোর্ড এলাকায় লাল চাঁদ সোহাগ নামে এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। শুক্রবার খুলনায় যুবদল নেতা মাহাবুবুর রহমান মোল্লাকে খুনের পর পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়েছে। চাঁদপুরে মসজিদের ভেতরে চাপাতি দিয়ে কোপানো হয় এক ইমামকে। পল্লবীতে চাঁদা না পেয়ে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে হামলা ও গুলি চালানো হয়। শ্যামলীতে এক যুবকের মানিব্যাগ ও কাঁধের ব্যাগ, মোবাইল ফোন সেট ছিনিয়ে নেওয়ার সময় তাঁর পরনের পোশাক, জুতাও অস্ত্রের মুখে খুলে নিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি, দখল, হামলার নানা ঘটনা সামনে আসছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের অপরাধ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়– চলতি বছরের জুন মাসে সারাদেশে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৪৪টি, মে মাসে ৩৪১, এপ্রিল ৩৩৬, মার্চে ৩১৬, ফেব্রুয়ারিতে ৩০০ ও জানুয়ারিতে ২৯৪। সদরদপ্তর আরো বলছে, কিছু মামলা রুজু হয়েছে যা পূর্ববর্তী মাসের ঘটনার। এ ছাড়া জুনে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা ১৯৩৩, মে মাসে ২০৮৭, এপ্রিল ২০৮৯, মার্চে ২০৫৪, ফেব্রুয়ারিতে ১৪৩০ ও জানুয়ারিতে ১৪৪০টি।
গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর বিভিন্ন থানা-ফাঁড়ি, পুলিশ বক্সে হামলা-ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হয়। এ সময় রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি, পিস্তল, শটগানসহ ৫ হাজার ৭৫৩ অস্ত্র লুট হয়। যার মধ্যে গতকাল পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে ৪ হাজার ৩৮৪টি। এখনও বেহাত ১ হাজার ৩৬৯ অস্ত্র। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগ্নেয়াস্ত্র বেশি দিন বেহাত থাকলে তা অপরাধ জগতে চলে যেতে পারে। এতে জনজীবনের নিরাপত্তায় হুমকি বাড়তে পারে।
দেশের আইনশৃঙ্খলার বর্তমান অবস্থার কথা তুলে ধরে পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় এখনও আসতে পারেনি। কোথাও আবার পুলিশ দলবদ্ধ আক্রমণের শিকার হচ্ছে। রাজনৈতিক পরিচয়ে কেউ কেউ অপরাধীদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ অনেক ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৩০টি। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ৬৬টি। ২২টি ঘটনায় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এই সময়ে গণপিটুনিতে ৮৯ জন নিহত হয়েছেন, ঢাকাতেই মারা গেছেন ৪৫ জন। এছাড়া এই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছেন ৪৪ জন।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পুরান ঢাকায় ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এ হত্যাকাণ্ড বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও দণ্ডহীনতার চলমান ধারার ফল।
রোববার সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভায় উপস্থিত এক কর্মকর্তা বলেন, বৈঠকে পুরান ঢাকায় লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। বৈঠকে বলা হয়, আসামিদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় দেখা হবে না। জড়িত সবাইকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হবে। এছাড়া সারা দেশে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ ও দখলবাজদের দ্রুত চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, পুরান ঢাকার ঘটনা দুঃখজনক। সভ্য সমাজে এটি মেনে নেওয়া যায় না। এটা সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে দেখছে। যারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের আইনের আওতায় আনতে সরকার বদ্ধপরিকর।
ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা আরও দুই মাস বাড়ল
বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব সমপদমর্যাদার কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (কোস্টগার্ড ও বিজিবিতে প্রেষণে নিয়োজিত সমপদমর্যাদার কর্মকর্তাসহ) বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা আরও দুই মাস বাড়িয়েছে সরকার। রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে এ তথ্য জানানো হয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৪ জুলাই থেকে পরবর্তী ৬০ দিন পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর সশস্ত্র বাহিনীকে (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এর পর থেকে এর মেয়াদ দুই মাস করে বাড়াচ্ছে সরকার।
আপনার মতামত লিখুন :