বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার মধ্য দিয়ে যেমন দেশের বহু মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীর জীবন রক্ষা পেয়েছে, তেমনি কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডে অনেকের জীবন রক্ষা পেয়েছে। এমনটিই মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সিনহা হত্যাকাণ্ডটি ঠাণ্ডা মাথায় করা হয়েছে। পুরোপুরি পরিকল্পিত ঘটনা ছিল। এই মামলার মূল বিষয় আসামিদের পরিচয় নয়, বরং মুখ্য হচ্ছে মেজর সিনহা। আসামিপক্ষের দাবি ছিল মেজর সিনহা চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালান। কিন্তু এ যুক্তি প্রত্যাখ্যান করেন অ্যাটর্নি জেনারেল।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আইনে আত্মরক্ষার অধিকার থাকলেও একটি মৌলিক নীতি বা ‘ডকট্রিন অব প্রোপোরশনালিটি’ রয়েছে। আপনি যদি দেখেন কেউ লাঠি হাতে আসছে, তার জবাবে গুলি করে হত্যা করা যাবে না। একইভাবে মেজর সিনহা গাড়ি থেকে নিরস্ত্র অবস্থায় দুই হাত তুলে নামেন, এরপর তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর নিশ্চিত করার জন্য তার গলায় পা দিয়ে চেপে ধরা হয়। এটা আত্মরক্ষার মধ্যে পড়ে না, এটি স্পষ্টতই হত্যা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আসামিরা যে আত্মরক্ষার অজুহাত দিয়েছে, তা প্রমাণে তারা কোনো সাক্ষী, মৌখিক প্রমাণ কিংবা পরিস্থিতিগত প্রমাণ পেশ করতে পারেনি। বরং মামলায় উপস্থাপিত সব সাক্ষী এবং আসামিদের জবানবন্দি বলছে, মেজর সিনহাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।’
সাক্ষাৎকারে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘একটা সময় বাংলাদেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থায় পুলিশের সাক্ষ্যকে অবিশ্বাস করা হতো। কিন্তু এখন সেই ধারা বদলেছে। পুলিশ সদস্যের সাক্ষ্যকেও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ করতে হবে আসামিপক্ষকেই। এই মামলায় মেজর সিনহার সঙ্গী শফায়েত, পথচারী ও স্থানীয় মসজিদের ইমামসহ অনেকের সাক্ষ্য এসেছে, যা একে অপরকে সমর্থন করেছে। তারা সবাই বলেছেন, মেজর সিনহা নিরস্ত্র ছিলেন। তাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘‘এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ ‘বিয়ন্ড অল রিজনেবল ডাউট’ প্রমাণ করতে পেরেছে যে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ছিল। আসামিরা প্রত্যেকে এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত।’’
এই আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘মেজর সিনহার মৃত্যু ছিল পাহাড়ের মতো ভারী। এটি পুরো জাতিকে নাড়া দিয়েছে। এই হত্যার বিচার করতে না পারলে তা হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক। আবরার ফাহাদ যেমন তার জীবন দিয়ে অনেক মেধাবী তরুণের জীবন বাঁচিয়েছেন, ঠিক তেমনি মেজর সিনহার মৃত্যুও অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছে, যারা ভবিষ্যতে এই ‘প্রদীপদের’ হাত থেকে রক্ষা পেল।’
ক্রসফায়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একসময় ক্রসফায়ারের নামে হত্যা হতো, পরে বলা হতো গুলি বিনিময় হয়েছে। কিন্তু আমরা বলেছি, মেজর সিনহার ঘটনাটি কোনো ক্রসফায়ার ছিল না, এটি পরিকল্পিত হত্যা। এখন সেই সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হলে এই হত্যার বিচার করতে হবে। এই বিচার শুধু সিনহার পরিবারের জন্য নয়, এটা আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও মূল্যবোধ রক্ষার জন্য।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই এমন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে, যা সুকান্ত ভট্টাচার্যের কাব্যের মতো আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।’
আপনার মতামত লিখুন :