বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের প্রধান গাছ হলো সুন্দরী। সুন্দরবনের নামকরণ নিয়ে নানা মত থাকলেও পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ এই বনের নাম যে সুন্দরী গাছের নামেই হয়েছে তা সর্বাধিক প্রচলিত। তবে নামে সুন্দরী হলেও ফুল আসার আগ পর্যন্ত এই গাছের রূপ বা সৌন্দর্য মানুষকে ততটা আকৃষ্ট করে না। বিশেষ করে এই গাছের যখন যৌবন আসে তখন ফুলে-ফলে শোভিত হয় বন। ফুল ফোটার পরই বিকশিত হয় তার প্রকৃত রূপ।
প্রকৃতিপ্রেমী আর ভ্রমণবিলাসী পর্যটকরা তখন সুন্দরী ফুলের মন মাতানো গন্ধে অন্য রকম এক প্রশান্তি অনুভব করেন। ফুলের ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন পর্যটকরা। মে মাসের শুরুতেই ফুল আসে সুন্দরীগাছে।
এখন চলছে সুন্দরীর সেই ভরা যৌবনা ফুল ফোটার মৌসুম। সুন্দরীর ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে গোটা সুন্দরবন। তবে অন্য সব বছরের তুলনায় এবার সুন্দরীগাছে ফুলের পরিমাণ বেশি। গাছে ফুল আসার শুরুতে এ বছর আগাম বৃষ্টিপাতের ফলে গাছে গাছে ঝাপিয়ে ফুল ফুটেছে বলে দাবি বন বিশেষজ্ঞ, বন বিভাগ, বনজীবী ও পর্যটন সংশ্লিষ্টদের।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দেশের মোট বনভূমির ৫১ ভাগই হচ্ছে সুন্দরবন। এই বনের ৭০ ভাগ জুড়েই সুন্দরীগাছের আধিপত্য। তবে পশ্চিম সুন্দরবন বিভাগের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের তুলনায় উপযুক্ত আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে বাগেরহাটের পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে সুন্দরী গাছের আধিক্য বেশি। মে মাস সুন্দরীগাছে ফুল ফোটার মৌসুম। ক্ষুদ্র সুন্দরী ফুল ঘণ্টাকৃতির। যা ৫ মিলিমিটার চওড়া এবং কমলা ও গোলাপি রঙের হয়ে থাকে।
সুন্দরবনের মধু আহরণকারী মৌয়াল শাহজাহান আকন, আলতাফ ঘরামী, বাবুল হাওলাদার এবং মৎস্য অবতরণে নিয়োজিত জেলে জামাল হাওলাদার ও রিপন ফরাজী জানান, তারা একেক জন ১৫ থেকে ২০ বছর ধরে সুন্দরবনে মধু ও মৎস্য আহরণ করে আসছেন। বনের বিভিন্ন এলাকায় বিচরণ করেন তারা। প্রত্যেক বছরই সুন্দরী গাছের ফুল তাদের চোখে পড়েছে। কিন্তু এ বছর যে পরিমাণ ফুল ফুটেছে তা অন্য সব বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এতো ফুল তারা আগে কখনো দেখেননি। বৃষ্টির কারণে দ্রুত ফুল ফুটেছে বলে তাদের ধারণা।
শরণখোলার পর্যটন ব্যবসায়ী মো. রাসেল আহমেদ বলেন, মৌসুমের শুরুতে এ বছর সুন্দরী গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। গত চারদিন আগে (৩ মে, রবিবার) একদল পর্যটক নিয়ে ডে-ট্যুরে শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্দা ইকো-পার্কে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে সুন্দরী গাছের ফুল দেখে অবাক হয়েছি। এর আগে ওই এলাকার গাছে এতো ফুল ফুটতে দেখেননি। ইকো- পার্কের ফুট ট্রেইল দিয়ে হাঁটার সময় মৌ মৌ ঘ্রাণ নাকে আসে। ফুলের সমারোহ আর মিষ্টি গন্ধে বিমোহিত হয়েছেন পর্যটকরাও।
সুন্দরী গাছে ব্যাপক ফুল আসার বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় এবার দ্রুত সমস্ত সুন্দরী গাছে ফুল আসতে পারে। এছাড়া উপযুক্ত পরিবেশের কারণে পূর্ণ বয়স্ক গাছের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ফুল ফোটায় অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি মনে হতে পারে।
ড. ওয়াসিল ইসলাম আরো বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে সুন্দরবনে। বৃদ্ধি পেয়েছে লবণাক্ততা ও ভাঙনের প্রবণতা। এর ফলে আগামরা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সুন্দরী গাছ। বিশেষ করে পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের বনাঞ্চলে লবণের মাত্রা বেশি হওয়ায় সুন্দরী গাছের আধিক্য কম। যে কারণে সুন্দরী গাছের আগামরা রোগের প্রবণতাও বেশি পশ্চিমে। সে তুলনায় বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে লবণের মাত্রা কম থাকায় সুন্দরী গাছের ঘনত্বও বেশি। তবে পূর্ব সুন্দরবন বঙ্গোপসাগর কোলঘেঁষা হওয়ায় ভাঙনে বিলীন হচ্ছে এ অঞ্চলের বনভূমি।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ বাগেরহাটের নবাগত বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধূরী বলেন, লবণের মাত্রা তুলনামূলক কম থাকায় শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে সুন্দরী গাছের ঘনত্ব বেশি। গাছের রোগবালাইও কম। যে কারণে গাছে গাছে ফুল ফোটায় দিগন্ত জুড়ে সুন্দরবন সৌন্দর্যের আবহ ছড়িয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :