স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন বা লবণাক্ত বনাঞ্চল সুন্দরবন নিয়ে এখনো কোনো স্বতন্ত্র মহাপরিকল্পনা করেনি সরকার। অপরিকল্পিত পর্যটন আর এই বন থেকে বেপরোয়া সম্পদ আহরণের কারণে এর ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়েছে। সুন্দরবন নিয়ে একটি সমন্বিত ইকো-ট্যুরিজম মহাপরিকল্পনা চাইছেন পর্যটন খাতসংশ্লিষ্টরা।
প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এই বনের বেশির ভাগ পড়েছে বাংলাদেশে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ৫১৭ বর্গকিলোমিটার। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার অংশ নিয়েই বাংলাদেশের সুন্দরবন। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনেস্কো এই বনকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে।
প্রাণী ও উদ্ভিদপ্রেমীদের জন্য সুন্দরবন এক অপার সৌন্দর্যের আধার, যার পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে বৈচিত্র্য। রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ নানা ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে সুন্দরবন পরিচিত। এখানে রয়েছে প্রায় ৩৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১২০ প্রজাতির মাছ, ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ সরীসৃপ এবং আটটি উভচর প্রাণী। সুন্দরবনের প্রধান বনজ বৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী, গেওয়া, ঝামটি গরান এবং কেওড়া। উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্যের সুরক্ষার পাশাপাশি এই ঐতিহ্য সংরক্ষণে দীর্ঘ পাঁচ দশকেও করা হয়নি স্বতন্ত্র মহাপরিকল্পনা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ১৯৯৫ সালে সারা দেশকে কাভার করতে ২০ বছর মেয়াদি একটি বনায়ন মহাপরিকল্পনা করা হয়েছিল। ওই মহাপরিকল্পনায় আলোচ্য সময়ে বনায়নের লক্ষ্যে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ লক্ষ্য নেওয়া ছিল। মেয়াদ শেষে দেখা গেছে, বনায়নে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যের ৩৮ শতাংশের কাছাকাছি।
এ ছাড়া মেয়াদ শেষে ওই মহাপরিকল্পনা থেকে কী পরিমাণ সুফল মিলেছে, তার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৫ সালে ওই মহাপরিকল্পনার মেয়াদ শেষের পর নতুন করে আরেকটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। দেশের অন্যান্য বনের সঙ্গে সেখানে ম্যানগ্রোভ বনকেও (সুন্দরবন) রাখা হয়েছে। কিন্তু সাড়ে ৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের সুন্দরবন অন্যান্য বনের চেয়ে পৃথক বৈশিষ্টের অধিকারী। সে কারণে এর পরিবেশ ও প্রতিবেশের সুরক্ষা দিয়ে কীভাবে পরিকল্পিত ইকো-ট্যুরিজমকে উৎসাহিত করা যায়, তা নিয়ে একটি সমন্বিত মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা দরকার। জার্নি প্লাস-এর সিইও তৌফিক রহমান বলেন, পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অঞ্চল রয়েছে আমাদের দেশে, অথচ এটি নিয়ে পৃথক কোনো মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি আজ পর্যন্ত। ‘সুন্দরবন ইকো-ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান’ শীর্ষক একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার, যার বাস্তবায়ন করছে বন বিভাগ। সেখানে পর্যটন করপোরেশন বা পর্যটন বোর্ডকে রাখা হয়নি।
তৌফিক রহমান বলেন, সুন্দরবন যেহেতু একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, এটিকে অন্যান্য পর্যটন স্পটের মতো মুক্তভাবে ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না। পরিকল্পিত পর্যটনের জন্য দরকার একটি সমন্বিত মহাপরিকল্পনা। এজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে ওই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অংশীদার করা উচিত। স্বাধীনতার পর ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও কেন সুন্দরবন নিয়ে মহাপরিকল্পনা প্রণিত হয়নি- জানতে চাইলে বন অধিদপ্তরের উপপ্রধান বন সংরক্ষক মো. মঈন উদ্দিন খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশের বন মহাপরিকল্পনার একটি অংশ হিসেবে সুন্দরবনকে বিবেচনা করা হয়েছে, সে কারণে এটি নিয়ে কোনো পৃথক মহাপরিকল্পনা হয়নি। বন অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, এখন যে সুন্দরবন ইকো ট্যুরিজম মাস্টারপ্ল্যান হচ্ছে সেখানে ইন্টিগ্রেটেড ম্যানগ্রোভ অঞ্চলের আওতায় তিনটি অভয়ারণ্য নিয়ে এই মাস্টারপ্ল্যানের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছে। প্রায় ৩৫ লাখ জনগোষ্ঠী এই বনের ওপর নির্ভরশীল। তারা এই বন থেকে সম্পদ আহরণ করে। এই জনগোষ্ঠীর বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করাই হবে ইকো-ট্যুরিজম মহাপরিকল্পনার লক্ষ্য।
উপপ্রধান বন সংরক্ষক আরও বলেন, খসড়া প্রণয়নে ট্যুরিজম বোর্ডসহ অংশীজনদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। তবে ট্যুরিজম বোর্ড ও আমাদের লক্ষ্য ভিন্ন। তাদের কাজ পর্যটনকে উৎসাহিত করা। কিন্তু সুন্দরবনে আমরা ঢালাওভাবে পর্যটনকে উৎসাহিত করতে চাই না। সে কারণে বন ও বনের বৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ ও সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টিই এ মাস্টারপ্ল্যানে গুরুত্ব পাচ্ছে। রূপান্তর ইকো-ট্যুরিজমের স্বত্বাধিকারী নাজমুল আজম ডেভিড বলেন, শুধু পর্যটন নিরুৎসাহিত করে সুন্দরবন সংরক্ষণ করা যাবে না। এজন্য এই বনের ওপর যে লাখ লাখ মানুষ নির্ভরশীল তাদের বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটি করা গেলে, এখানে একটি আদর্শ ইকো-ট্যুরিজম ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে, যার মাধ্যমে প্রচুর বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব হবে।
আপনার মতামত লিখুন :