পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘এবং আমি ইবরাহিমকে পাঠালাম, যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, আল্লাহর ইবাদত করো ও তাঁকে ভয় করো। এটিই তোমাদের পক্ষে শ্রেয়। যদি তোমরা সমঝদারির পরিচয় দাও। তোমরা যা করো তা তো কেবল এই যে, মূর্তিপূজা করো ও মিথ্যা রচনা করো। নিশ্চিত জেনো, তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত করো তারা তোমাদেরকে রিজিক দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং আল্লাহর কাছে রিজিক সন্ধান করো, তাঁর ইবাদত ও তাঁর শোকরগোজারি করো। তাঁরই কাছে তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হবে।’ (সূরা আন কাবুত : ১৬-১৭)
এ সূরাটি শুরু হয়েছে দ্বীন ও ঈমানের জন্য দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার মানসিক প্রস্তুতি শিক্ষাদানের মাধ্যমে। সাথে সাথে এই সুসংবাদ দেয়া হয়েছে যে, যারা এগুলো সহ্য করে দ্বীনের উপর টিকে থাকবে তারাই প্রকৃত মুমিন। সূরাটিতে তাওহিদ, রিসালত ও আখিরাত সম্পর্কে নবী ও রাসূলদের দাওয়াত বর্ণনা করা হয়েছে। উপরের আয়াতগুলোতে আছে ইবরাহিম (আ.)-এর দাওয়াতের বিবরণ। তিনি তার কওমকে তাওহিদের দাওয়াত দিয়েছেন। যুগে যুগে নবী ও রাসূলের দাওয়াত ছিল এমনই স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, তাওহিদকে গ্রহণ করাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর যদি তোমাদের কিছুমাত্র জ্ঞানবুদ্ধি থাকে।
কোনো সত্তাকে গায়বিভাবে ভালো-মন্দের মালিক এবং সব হাজত পুরা করার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করে তার সামনে নিজের নিতান্ত হীনতা ও মুখাপেক্ষিতা প্রকাশের জন্য, তাকে রাজি-খুশি করার জন্য এবং তার নৈকট্য অর্জনের জন্য যেসব উপাসনামূলক কাজ করা হয় তাকেই ইবাদত বলে। যেমনÑ নামাজ, সদকা, রোজা, হজ, নজর-মান্নত ইত্যাদি। ইবাদত একান্তভাবে আল্লাহ তাআলার অধিকার। কেউ যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সাথে এই আচরণ করে তবে সে নিঃসন্দেহে মুশরিক।
তাওহিদের মূল কথা হলোÑ আল্লাহ তাআলাকে তাঁর জাত ও সিফাতে (সত্তা ও গুণাবলিতে) এক ও অদ্বিতীয় বলে মেনে নেয়া এবং তার কোনো শরিক ও সমকক্ষ নেই তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা। এই বিশ্বাস রাখা যে, ইবাদত লাভের উপযুক্ত একমাত্র তিনি, সব পশুপ্রাণীর সৃষ্টিকর্তা ও রিজিকদাতাও তিনি। এগুলোর কোনোটিতেই তাঁর কোনো শরিক নেই।
এরপর তাকওয়ার উল্লেখ হয়েছে। এ শব্দটি ব্যাপক অর্থ ও মর্ম ধারণ করে। তাকওয়ার মূল বক্তব্য হলোÑ আল্লাহ তাআলার ভয়ে সব গুনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। তাকওয়ার প্রথম ধাপ, জঘন্যতম গুনাহ শিরক থেকে নিজেকে পাকসাফ রাখা। তাকওয়ার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তাআলার অপছন্দীয় কাজ থেকে বিরত থাকতে পারে। তাকওয়ার দ্বারা বান্দা আল্লাহর পছন্দনীয় আমল করতে পারে। তাকওয়াই পারে বান্দাকে নফস ও শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে নিরাপদ রাখতে। পারে তার মানবীয় গুণগুলো জাগিয়ে তুলতে এবং পূর্ণাঙ্গ মানবে পরিণত করতে।
এরপর ইবরাহিম (আ.) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পৌত্তলিকতার অসারতা তুলে ধরেছেন। নিজ হাতে গড়া এ মূর্তি, যার কল্যাণ-অকল্যাণের কোনো ক্ষমতা নেই, কেন তোমরা নিজেদেরকে তার সামনে অবনত করছ? কেন তোমরা এই মিথ্যা রচনা করছ যে, এই সব মূর্তি তোমাদের ইবাদত ও উপাসনা পাওয়ার যোগ্য। তোমাদের কর্তব্য এক আল্লাহর ইবাদত করা, সব শিরক ও শরিককে বর্জন করা। কেননা, তিনিই তোমাদেরকে রিজিক দেন, তিনিই আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং শুষ্ক জমিনকে ফল-ফসলে ভরে দেন।
কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছেÑ ‘নিশ্চয় আল্লাহ শস্য বীজ ও আটি বিদীর্ণকারী। তিনি প্রাণহীন বস্তু থেকে প্রাণবান বস্তু নির্গত করেন এবং তিনিই প্রাণবান বস্তু থেকে নিষ্প্রাণ বস্তুর নির্গতকারী। হে মানুষ! তিনিই আল্লাহ। সুতরাং তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করে কোন দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? তিনিই সেই সত্তা, যার হুকুমে ভোর হয়। তিনিই রাতকে বানিয়েছেন বিশ্রামের সময় এবং সূর্য ও চন্দ্রকে করেছেন এক হিসাবের অনুবর্তী। এই সমস্ত সেই সত্তার পরিকল্পনা, যার ক্ষমতাও পরিপূর্ণ, জ্ঞানও পরিপূর্ণ।
তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্র সৃষ্টি করেছেন, যাতে তার মাধ্যমে তোমরা স্থল ও সমুদ্রের অন্ধকারে পথ জানতে পারো। একেক করে সমস্ত নির্দেশনা স্পষ্ট করে দিয়েছি সেই সব লোকের জন্য, যারা জ্ঞানকে কাজে লাগায়। তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদের সবাইকে একই ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর প্রত্যেকের রয়েছে এক অবস্থানস্থল ও এক আমানত রাখার স্থান। আমি একেক করে সমস্ত নিদর্শন স্পষ্ট করে দিয়েছি সেই সব লোকের জন্য, যারা বুঝ-সমঝকে কাজে লাগায়।
আর আল্লাহ তিনিই, যিনি তোমাদের জন্য আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন। তারপর তা দ্বারা আমি সর্বপ্রকার উদ্ভিদের চারা উদগত করেছি। তারপর তা দ্বারা সবুজ গাছপালা জন্মিয়েছি, যা থেকে আমি থরে থরে বিন্যস্ত শস্যদানা উৎপন্ন করি এবং খেজুর গাছের চুমরি থেকে (ফলভারে) ঝুলন্ত কাঁদি নির্গত করি এবং আমি আঙ্গুর বাগান উদগত করেছি এবং জায়তুন ও আনারও। তার একটি অন্যটির সদৃশ ও বিসদৃশ। যখন সে বৃক্ষ ফল দেয়, তখন তার ফলের প্রতি ও তার পাকার অবস্থার প্রতি গভীরভাবে লক্ষ করো। এসবের মধ্যে সেই সব লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যারা ঈমান আনে। (সূরা আন আম : ৯৫-৯৯)।
আপনার মতামত লিখুন :