আজকের নিবন্ধে আমি অতীত ইতিহাসের তিতা কথাগুলো বলব না। বরং বাঙালির বীরত্ব-বুদ্ধিমত্তা-সাহস-শক্তির আবহমান ইতিহাসের কিছু দিক তুলে ধরব, যাতে করে
পাঠক সহজে বুঝতে পারবেন কেন আমরা বারবার পরাজিত হয়েছি : কেন আমরা বারবার সুখের সময়ে ভূতের দলের কবলে পড়েছি এবং দিনে রাতে ভূতের কিল খেয়ে লোকালয় ছেড়ে বনবাদাড়ে আশ্রয় নিয়েছি। কেন বারবার আমাদের ভূখণ্ড দক্ষিণ ভারতের চাণক্য বংশ, দিল্লির সুলতান- সম্রাট ছাড়াও কানপুর, জৌনপুর, বিহার, ওডিশা, নাগপুর, কামরূপ, ত্রিপুরা কিংবা মুর্শিদাবাদের ছোট ছোট সামন্ত রাজার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। কেন পৃথিবীর হাজার হাজার জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে বাঙালিকে বলা হয় এমন জাতি যারা সব সময় শক্তের ভক্ত এবং নরমের যম হিসেবে গিনেস বুকে গড়া নিজেদের রেকর্ড বারবার নিজেরাই ভেঙে চুরমার করে নতুন ইতিহাস গড়েছে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলব- তার আগে আরও একটি মজার ইতিহাস বলার লোভ সামলাতে পারছি না।
বাংলার ইলিয়াস শাহি বংশের তিনজন বিখ্যাত শাসক যথা- সামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ, সিকান্দার শাহ এবং গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের পর এই রাজবংশের লোকদের ভূতে কিলানো আরম্ভ করে। বাংলা, বিহার, ওডিশা ছাড়াও আধুনা ভারেেতর সেভেন সিস্টারসের বহু অংশ তাদের দখলে ছিল এবং সমগ্র ভারতবর্ষ তো বটেই তামাম দুনিয়ায় তখন বাংলার ধনসম্পদ, শিল্প-কলকারখানা, শিল্পসাহিত্য এবং সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব মশহুর ছিল। দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক পরপর দুইবার বাংলা আক্রমণ করে ব্যর্থ হন এবং ভবিষ্যতে আর কোনো আক্রমণ করবেন না এই শর্তে সিকান্দার শাহের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে ফিরে যান। ফলে পরবর্তী ২০০ বছর বাংলা স্বাধীন ছিল। ফলে বাংলার ঐতিহ্য এবং আর্থিক উন্নয়ন চরমে পৌঁছে আর এ অবস্থায় আমাদের পূর্বপুরুষদের ভাগ্যে কী বিপর্যয় নেমে এসেছিল এবং কীভাবে বাঙালি শক্তের ভক্ত নরমের যমে পরিণত হয়েছিল, তা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি।
পরপর তিনজন সফল শাসকের কল্যাণে বাংলার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটেছিল। ভারতবর্ষের সবচেয়ে চৌকশ ব্যবসায়ীরা বাংলায় এসে তাদের ব্যবসাবাণিজ্যের সদর দপ্তর স্থাপন করেছিলেন। জ্ঞানী-গুণীরা এসে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন। ধর্ম প্রচারক, বিজ্ঞানী-কবি-সাহিত্যিক এবং সচ্ছল জনগণের সম্মেলনে সোনারগাঁ, গৌড়, পাটনা, মুর্শিদাবাদ, পাতুয়া প্রভৃতি নগরে যে প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে উঠেছিল সেখানে ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সুশাসন ও প্রজা অধিকার রক্ষার যে নজির স্থাপত হয়েছিল, তা সমসাময়িক দুনিয়ার অন্য কোথাও ছিল না। জনগণ অবাধে রাজার সমালোচনা করত। আমলারা অন্যায় করলে তাদের বিরুদ্ধেও কাজির দরবারে মামলা করে দিতেন - রাজা বা সামন্ত রাজারা অন্যায় করলে তাদের বিরুদ্ধে কাজির দরবারে নালিশ জানালে বিচারক সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতেন।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের পরবর্তী দুর্বল শাসকরা প্রথমে জনগণকে ভয় পেতে শুরু করেন। তারপর রাজ্যের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের পরবর্তী দুর্বল শাসকরা প্রথমে জনগণকে ভয় পেতে শুরু করেন। তারপর রাজ্যের সামন্তপ্রেমী ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের হিংসা করতে থাকেন এবং সব নষ্টের কারিগর রূপ-জ্ঞানীগুণী-পণ্ডিতদের শত্রুরূপে ধ্যানজ্ঞান করতে থাকেন। তাদের মধ্যে রোকন উদ্দিন বারবাক শাহ বাংলার লোকদের ভয় দেখানোর জন্য এবং নিজের নিরাপত্তার জন্য আবিসিনিয়া থেকে প্রচুর দাসদাসী কিনে আনেন এবং তাদের নিজের দেহরক্ষী, প্রাসাদরক্ষী ও হেরেম পাহারা দেওয়ার কাজে নিযুক্ত করেন। এদের হাবসি বলা হতো। এদের অত্যাচার ও অসভ্যতামির কাছে পাকিস্তান জমানার এনএসএফ, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের রাজাকার-আলবদর অথবা সাবেক সরকারের জমানার ছাত্রলীগ-যুবলীগের অত্যাচার ও অনাচার ছিল নস্যি। ফলে তৎকালীন বাংলার জ্ঞানীরা বিদ্যাবুদ্ধি বিসর্জন দিল, ব্যবসায়ীরা ভারতের অন্যান্য অংশে চলে গেল, কাজিরা ন্যায়বিচার বন্ধ করল-কোতোয়াল (পুলিশ), ফৌজদারি (আর্মি), দেওয়ান (সিভিল সার্ভেন্ট) এবং দেশীয় সামন্তরা হাবসি দাসদের পদলেহন করল। এ অবস্থায় একজন হিজড়া হাবসি দাস ইলিয়াস শাহি বংশের সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে বসলেন। বারবাক নামক সেই হাবসি হিজড়ার অত্যাচারে ১৪৮৭ সালে সুবে বাংলার অধিবাসীরা যেভাবে শক্তের ভক্ত ও নরমের যমে পরিণত হয়েছিলেন, তা ২০২৫ সালের মে মাসে এসে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার কিছু বাস্তব উদাহরণ দিয়ে আজকের নিবন্ধ শেষ করব।
আজকের দিনে আপনি যদি গ্রামের টং ঘরের কোনো চা-দোকানিকে জিজ্ঞাসা করেন দেশের শীর্ষ শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর দুরবস্থা কেন? তিনি এমনভাবে কথা বলবেন যেন তাকে- যেকোনো শিল্পগোষ্ঠীর বোর্ড অব ডাইরেক্টরসের চেয়ারম্যান বানালে সব সমস্যা মুহূর্তের মধ্যে দূর হয়ে যাবে। ঠিক একইভাবে আপনি যদি রাস্তার পাশে পসরা সাজিয়ে বসা সাইকেলের মেকানিককে রোলস রয়েস অথবা বোয়িং ৭৮৭ মেরামতের কথা বলেন, তিনি খুশিমনে সর্বশক্তি নিয়ে আপনার সঙ্গে রওনা দেবেন।
আমাদের দেশের নাপিত মনে করে, সে যদি মন্ত্রী হয় তবে দেশ অচিরে লন্ডন-আমেরিকা হয়ে যাবে। পাড়া-মহল্লার ছিঁচকে মস্তান অথবা ছিনতাইকারীর ধারণা, তারা আইজি হলে দেশের আইনশৃঙ্খলা মুহূর্তের মধ্যে জাদুকরি জান্নাতি রূপ লাভ করবে। এ দেশের অনেক জোব্বাওয়ালা মনে করে তসবি টিপে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফুঁ দিলে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানের বিজয় নিশ্চিত হবে। ঢাকার রাস্তায় বিশাল সমাবেশ করে লন্ডন-আমেরিকাকে ভয় দেখানো সম্ভব এবং ইসরায়েলের নেতানিয়াহুকে হামাসের কাছে আত্মসমর্পণ করানো কোনো বিষয়ই না।
বাংলাদেশে বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া হয়। এ দেশের দরিদ্র অসহায় এবং সুন্দরী মেয়েদের ওপরই সব সময় ভূত-জিন-পরিরা ভর করে এবং তা তাড়ানোর জন্য রাতবিরেতে সাধু-সন্ন্যাসী জটাধারী এবং জোব্বাওয়ালা তাবিজবাজদেরই দরকার পড়ে। এখানকার মানুষ শৌচকর্মের জন্য বদনাকে জাতীয় সম্পদ মনে করে এবং লন্ডন-আমেরিকা প্রবাসী হয়েও বদনা-শৈশবের পাট খেতে প্রাকৃতিক কর্ম এবং দূর্বাঘাসে হ্যাচড় দেওয়ার কথা স্মরণ করে আবেগে গদগদ হয়ে পড়ে। তারা ডিমকে আন্ডা কিংবা বয়জা বলে এবং প্রতিপক্ষকে গরম ডিমের থেরাপি দেওয়ার স্বপ্ন দেখে। তারা গভীর রাতে একাকী চলতে গিয়ে ভয় পেলে গান করে এবং কোনো কিছুর সন্দেহজনক নড়াচড়া দেখলে ওরে বাবারে ওরে মারে বলে আর্তচিৎকার করে প্রাণপণ দৌড়ে বাড়ির দরজায় পৌঁছে, তারপর পরিবারের প্রিয়জনকে দেখামাত্র আবেগে জ্ঞান হারিয়ে বাড়িতে কান্নায় রোল তুলে দেয়।
বাঙালি ক্ষমতা পেলে নিজেকে অতিমানব-মহামানব কিংবা দানব মনে করে। আর ক্ষমতা হারালে মুহূর্তের মধ্যে ইঁদুরের গর্তে ঢুকে যায়। তারপর সেই গর্তে বসে রাতের আঁধারে আকাশের তারা গোনে। কল্পনার বাসর সাজিয়ে আবাবিল পাখি-সিন্দাবাদের দৈত্য অথবা অন্য কোনো অলৌকিক শক্তির কথা ভাবতে থাকে। এ দেশের ক্ষমতাধরদের দেখলে বা তাদের হাবভাব দেখলে মনে হয়, তারা যেন সম্রাট আকবরের পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীর। আর ক্ষমতাধর মহিলাদের দেখলে মনে হয় তারা সুলতান সুলেমানের সম্রাজ্ঞী হুরবাম সুলতানের কার্বন কপি। তাদের জ্ঞান এত বেশি যা কিনা সক্রেটিস প্লেটো অ্যারিস্টটলের সম্মিলিত জ্ঞানের চেয়েও অধিকতর আর তাদের ক্ষমতা দারায়স-সাইরাস-সারগণ শি হুয়ান টি সিজার নেপোলিয়ন অথবা হানিবল বার্কারের চেয়েও বেশি।
উল্লিখিত ক্ষমতাধরদের ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর তাদের হাবভাব দেখলে মনে হবে, তারা যেকোনো দিন মানুষ ছিল সে চিন্তা বিশ্বাস তাদের মনমস্তিষ্ক থেকে চলে গেছে। নিজেদের তারা হীনম্মন্যতার এমন পর্যায়ে নামিয়ে আনে, যা দেখে মনে হতে পারে যে তারা হয়তো ভাবছে ইস্ যদি মানুষ না হয়ে বিলাই হতাম। কিংবা ময়না-টিয়া শালিক হতে পারতাম। ক্ষমতা হারিয়ে তারা ফুটো বেলুনের মতো ফুঁস করে নিজের আকার-আকৃতি হারিয়ে ফেলে এবং টুস করে কোনো ইঁদুরের গর্তে এমনভাবে ঢুকে পড়ে যা দেখলে সম্রাট আলেকজান্ডার তার সেনাপতি সেলুকাসকে কী বলতেন, তা নিয়ে আমাদের হয়তো বহুদিন গবেষণা করতে হবে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক