অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের এগার মাসেও পুলিশ বাহিনীর ভেতরের অস্থিরতা পুরোপুরি কাটেনি, দূর হয়নি সংকটও। কিছুটা গতিশীল হলেও সঠিক নেতৃত্বের অভাবে পদায়ন-বদলি, পদোন্নতি বা চাকরিচ্যুতি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিভক্তিসহ নানা ধরনের জটিলতা নিয়ে চলছে রাষ্ট্রের আইন-শৃংখলা রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা পুলিশ বিভাগ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে এখনও পুলিশ বাহিনীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিতকিত সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম-হাবিবুর রহমান সিন্ডিকেট। পতিত আওয়ামী সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ৫ অতিরিক্ত আইজিপি ও ৩৫ ডিআইজি পুলিশ সদর দফতরসহ বিভিন্ন ইউনিট প্রধানসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছে।
শূণ্য পদ থাকার পরেও পতিত আওয়ামী সরকারের দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর বঞ্চিত থাকা পেশাদার ও যোগ্য কর্মকর্তারা এখনও পদোন্নতি পাচ্ছেন না অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজি পদে। অথচ সরকারের অন্যান্য ক্যাডারদের মধ্যে ক্ষমতা অপব্যবহারকারী ১৫তম বিসিএস কর্মকর্তারা অনেক আগেই অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এমনকি ২০মত বিসিএস কর্মকর্তারা অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছেন। পুলিশ বাহিনীতে এ ধরনের বৈষম্যের কারনে একদিকে দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা উন্নয়নে প্রভাব পড়ছে। অন্যদিকে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে বিরাজ করছে চরম ক্ষোভ। অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজির মতো পুলিশ বাহিনসীর গুরুত্বপূর্ণ পদে শূণ্যপদ থাকার পরেও রহস্যজনক কারনে হচ্ছে না এসএসবি।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে এখনও অনেক কর্মকর্তাই বহাল রয়েছেন, যারা জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালানো এবং হত্যাকা-ের সাথে জড়িত। একই সাথে একাধিক হত্যা মামলার আসামি হয়েও অনেক কর্মকর্তাই পুলিশ বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের নানা পদে রয়েছেন। এসব কর্মকর্তারা একদিকে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাচার করছেন পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা এবং পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে, অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে থাকলেও দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা রাখছেন না। ফলে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির ক্ষেত্রে ধীরগতিতে কাজ করতে হচ্ছে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের একাধিক সূত্র বলছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের মধ্যে বড় ধরনের দূরত্ব ওপেন সিক্রেট। ফলে অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজির অর্ধশত পদ কয়েক মাস ধরে খালি থাকার পরেও পদোন্নতি বা পদায়ন করা হচ্ছে না। এ নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের মধ্যে রশি টানাটানি চলছে। এতে করে সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়ন, নাগরিকসেবা, সামাজিক শৃঙ্খলা ও আইনি সুরক্ষার কাজটিও যথাযথভাবে হচ্ছে না। বরং কোথাও কোথাও পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। অল্প সময়ের মধ্যে পুলিশ বাহিনীতে দাপিয়ে বেড়ানো মনিরুল ইসলাম-হাবিবুর রহমান গংদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করে পুরো পুলিশ বাহিনীকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। অন্যতায় এসব কর্মকর্তারা নির্বাচনে বিশৃংখলা তৈরি করাসহ নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করবে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারকে সম্পূর্ণভাবে গতিশীল করতে হলে রাষ্ট্রের এই প্রতিষ্ঠান পুলিশ বাহিনীকে দ্রুত সক্রিয় করতে হবে। পতিত আওয়ামীলীগ সরকারের সময় যারা পুলিশ বাহিনীতে থেকে সরকার বিরোধী মত প্রকাশে গুলি-লাঠি চালিয়েছেন এমন অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজি পদে প্রায় ৪০জন কর্মকর্তা বহাল তবিয়তে থাকা অন্তবর্তীকালিন সরকারের জন্য দু:খজনক। দ্রুত এদের বিরুদ্ধে যেসব গুরুত্বর অভিযোগ রয়েছে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। একই সাথে যোগ্য ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে দ্রুত পদায়ন করা খুবই জরুরি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার দশ মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশের ভাবমূর্তি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ও সংস্কারের জন্য দৃশ্যমান উদ্যোগ তেমন চোখে পড়ছে না। দৃশ্যত পুলিশ বাহিনীতে পদোন্নতি, বদলি ও পদায়নের ভাটা পড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদে ও স্থানে এখন বহাল রয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাপক রাজনীতিকরণ এবং দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা।
রহস্যজনক কারণে যোগ্য কর্মকর্তা থাকার পরেও সরকারি কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে গঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) বৈঠক হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অনেকটাই নিস্ক্রিয়। ফলে পুলিশ পুনর্গঠন ও সারাদেশের পুলিশ ইউনিটগুলোকে সক্রিয় করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। শহীদদের রক্তের বিনিময়ে দেশে নতুন সরকার গঠন হলেও খুনের সাথে জড়িত শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়েই বৈঠক করছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী, স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশ সদর দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের রেখে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার করা সম্ভব নয়। অতিরিক্ত আইজিপি ও ডিআইজিদের পদোন্নতি দেয়া হলে দ্রুত অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপি ও অতিরিক্ত এসপি পদে পদোন্নতি পাবেন যোগ্য-বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তারা। সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ প্রশাসনের বাইরে অন্যান্য ক্যাডারে এ ধরনের শূন্য পদ থাকার নজির নেই। দেশের আইন-শৃঙ্খলা যেন উন্নয়ন না হয় এবং পুলিশ বাহিনীর মধ্যে চেইন-অব-কমান্ড যেন ফিরে না আসে সে জন্যই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে পদোন্নতি ও পদ খালি রেখে চলছে পুলিশ বাহিনী এমন মন্তব্য করেন এসব কর্মকর্তা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা রোববার বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের পতন হলেও হত্যায় অভিযুক্ত ও ইন্ধনদাতা পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা সদর দপ্তরের বিশেষ মনিটরিং সেল থেকে সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও নিপীড়নের আদেশ সমন্বয়ের কাজ করেছেন, ফ্যাসিবাদের সেসব দোসররা পদায়ন পেয়ে এখনো পুলিশ স্টাফ কলেজ, হাইওয়ে ও ট্যুরিস্ট পুলিশ, এসবি, সিআইডি, পুলিশ হেডকোয়ার্টারের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত রয়েছেন। ফলে আওয়ামী লীগের আমলে বৈষম্যের শিকার পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো বঞ্চিত হচ্ছেন। এর ফলে পেশাদার, সৎ ও বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
আপনার মতামত লিখুন :