দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল ছিল রাজধানীর গণভবন। এখান থেকেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। শেখ হাসিনার শাসনামলে এই রাষ্ট্রীয় ভবনটি রূপ নেয় কার্যত তার ব্যক্তিগত বাসভবন ও আওয়ামী লীগের মূল রাজনৈতিক কার্যালয়ে। কৃষি-মৎস্যসহ নানা কার্যক্রম চলত শেখ হাসিনার ইচ্ছানুযায়ী। দলীয় সভা-সমাবেশ ও নীতিনির্ধারণেও ব্যবহার হতো সরকারি এই স্থাপনাটি।
তবে ইতিহাস বদলে যায় ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এই অভ্যুত্থানেই পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। বিক্ষোভকারীরা গণভবনে প্রবেশ করে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। দেয়ালে লেখে বিভিন্ন প্রতিবাদী বার্তা—যা আজও অক্ষত রয়েছে। ১৪ জুলাইয়ের এক ঘোষণায় সরকার জানায়, গণভবনকে এখন রূপান্তর করা হচ্ছে ‘জুলাই স্মৃতি জাদুঘরে’। আগামী ৫ আগস্ট এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে, যা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
সোমবার গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী বলেন, “গণভবন ছিল একটি ক্রাইম জোন। এখান থেকেই গুম-খুন ও নিপীড়নের পরিকল্পনা করা হতো। জাদুঘরের মাধ্যমে সেই ইতিহাসই সামনে আনা হবে।”
তিনি জানান, ভবনটিকে এমনভাবে সাজানো হবে, যাতে ‘শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলের বাস্তব চিত্র’ স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।
২০০১ সালে টোকেন হিসেবে মাত্র এক টাকায় শেখ হাসিনার নামে গণভবন ইজারা দেওয়া হয়। পরে ২০০৯ সালের ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন’ অনুযায়ী তা বৈধতা পায়। যদিও এরপর বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক চাপের মুখে এই ইজারা বাতিল হয় এবং ২০০১ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা গণভবন ছাড়েন।
গণভবনটি নির্মিত হয় ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে। তবে শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কোনো প্রধানমন্ত্রী এখানে কখনো বসবাস করেননি। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীগণ সেনানিবাসের বাসভবন ব্যবহার করতেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণভবনের দেয়াল ভেদ করে ঢুকে পড়ে হাজারো বিক্ষুব্ধ জনতা। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সাধারণ মানুষ লিখে রাখে নানা বার্ত—“শেখ হাসিনা স্বৈরাচার”, “হাসু আপা পলাইছে”, “আবু সাঈদের রক্ত বৃথা যাবে না”—এমন বহু স্লোগান এখনো রয়ে গেছে দেয়ালজুড়ে।
সাংবাদিক বোরহানুল আশেকীন বলেন, “একটা সময় গণভবন ছিল দম্ভের প্রতীক, এখন সেটা ইতিহাসের স্মারক।” আরেক সাংবাদিক সাজেদা সুইটি বলেন, “গণভবন ছিল জনগণের সম্পদ, যা একনায়কত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে। সেখানকার দেয়ালে জনগণের ক্ষোভ আজও স্পষ্ট।”
প্রতিবাদকারীদের চাপে পদত্যাগের পর শেখ হাসিনা ও তার বোন দেশ ছাড়েন। এরপর গণভবন রূপ নেয় জনতার আক্রোশের মঞ্চে। ভেঙে পড়া দেয়াল, বিলুপ্ত নিরাপত্তা, ছিন্নমূল স্মারক—সব কিছু যেন ইতিহাসের নিরব সাক্ষী। জুলাই স্মৃতি জাদুঘর শুধু ইতিহাস সংরক্ষণই নয়, ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্যও সতর্কবার্তা। শাসকদের উদ্দেশ্যে বার্তা পরিষ্কার—গণভবন জনগণের, তাদের ক্ষোভের মূল্য দিতে হয় দম্ভের রাজনীতিকে।
আপনার মতামত লিখুন :