

* জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন * জড়িত আওয়ামী লীগ সমন্বয়কারী তাপস
পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রিন সিগন্যালেই বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস) হত্যা সংঘটিত হয়েছে। জাতির ইতিহাসে ন্যক্কারজনক এ ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের রক্ষা করতে দলগতভাবে জড়িত ছিল আওয়ামী লীগ। মূল সমন্বয়কারীর দায়িত্বে ছিলেন পতিত সরকারের তৎকালীন সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস। বহুল আলোচিত বর্বর এ হত্যাযজ্ঞের তদন্তে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভয়াবহ এসব তথ্য।
কমিশনের প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানসহ অন্য সদস্যরা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গতকাল প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। এ সময় কমিশনের সদস্য মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার (অব.), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাইদুর রহমান বীরপ্রতীক (অব.), যুগ্মসচিব (অব.) মুন্সী আলাউদ্দিন আল আজাদ, ডিআইজি (অব.) ড. এম আকবর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শরীফুল ইসলাম এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন উপস্থিত ছিলেন।
পরে সংবাদ ব্রিফিংয়ে তদন্ত কমিশনের প্রধান ফজলুর রহমান বলেন, তদন্ত করতে গিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। অনেক সংস্থাকে দিনের পর দিন চিঠি লিখে জবাব পাইনি। হয়তো আজ একটা তথ্য জানতে চেয়েছি, এক মাস পর জানিয়েছে তথ্যটা তাদের কাছে নেই। সরকারি-বেসরকারি ২৭টি প্রতিষ্ঠানকে ৯০৫টি চিঠি দিয়েছি। অনেক অনুসন্ধানের পর আমরা বিডিআর হত্যাকাণ্ড কেন হয়েছিল, কারা জড়িত, কেন সেনাবাহিনী পদক্ষেপ নেয়নি, কীভাবে ষড়যন্ত্র দানা বেঁধেছিল- এগুলোর আদ্যোপান্ত বের করতে সক্ষম হয়েছি। তিনি বলেন, জড়িতদের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তি পেয়েছি, সিভিলও জড়িত ছিল।
জড়িতদের মধ্যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, শেখ সেলিম, মির্জা আজম, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাহারা খাতুন, জেনারেল তারেক এবং প্রাক্তন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন, প্রাক্তন ডিজিএফআই প্রধান জেনারেল আকবর- এগুলো ওপর লেভেলের নাম। বিডিআর বিদ্রোহ অনেকগুলো কারণে হয়েছিল। প্রথমত বিডিআরের ভিতরে ক্ষোভ ছিল। যেমন ডাল ভাত কর্মসূচি একটা। আবার বিডিআর শপ তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে বিডিআর সদস্যদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল, যা তাদের মূল দায়িত্বের সঙ্গে যায় না। কিছু বিডিআর সদস্য সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের তাদের মাঝে চাচ্ছিলেন না।
ওই সময় সরকার তার ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছিলেন। প্রতিবেশী দেশ ভারত বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল। সেনাবাহিনী, বিডিআরকে দুর্বল করতে চেয়েছিল। নানা ইস্যু সামনে এনে আর্মি অফিসারদের প্রতি বিডিআর সদস্যদের ক্ষেপিয়ে তোলা হয়। দরবার হলে যেখানে সেনাবাহিনীর অফিসাররা নিহত হয়েছেন, তার থেকে ৩০-৪০ মিটারের মধ্যেই ৫ নম্বর গেট। সেখানে র্যাব সদস্যরা সজ্জিত ছিলেন। তারা এগিয়ে আসেননি। ওই সময় এডিজি ছিলেন কর্নেল রেজা নূর। তিনি তাদের নিষেধ করেছিলেন।
ফজলুর রহমান বলেন, তদন্তকাজ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও ত্রুটিমুক্ত করার স্বার্থে সর্বোচ্চ পেশাদারি বজায় রাখা হয়েছে। আমরা যখন কাজ শুরু করি তখন ১৬ বছর আগের এ ঘটনার বহু আলামত ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকে বিদেশে চলে গেছেন। কমিশন দুটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাক্ষীদের কারও কারও আট ঘণ্টা পর্যন্ত বক্তব্য শুনেছি আমরা। যতক্ষণ তিনি বলতে চেয়েছেন। যারা তদন্তে জড়িত ছিলেন, তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তাদের তদন্তের রিপোর্ট সংগ্রহ করেছি। প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণও সংগ্রহ করা হয়েছে।
জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সদস্যদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতি দীর্ঘদিন ধরে অন্ধকারে ছিল। আপনারা সত্য উদ্ঘাটনে যে ভূমিকা রেখেছেন, জাতি তা স্মরণে রাখবে। জাতির পক্ষ থেকে আপনাদের প্রতি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ এবং স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি।
প্রসঙ্গত, গত বছর ২৩ ডিসেম্বর রাজধানীর পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দপ্তরে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি নৃশংস হত্যাযজ্ঞের তদন্তে সাত সদস্যের স্বাধীন জাতীয় কমিশন গঠন করা হয়। তদন্ত কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন, সামরিক বাহিনীর দুজন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, সিভিল সার্ভিসের একজন ও পুলিশের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা।
আপনার মতামত লিখুন :