এলাকার সবাই জানে ট্রাক্টর দুর্ঘটনায় দেড় বছর আগে নিহত হয়েছিল স্কুল ছাত্র তারিফ। এ নিয়ে মামলা, চার্জশিট, ড্রাইভার আটক, মিমাংসা সবই হয়েছিল। কিন্তু এতদিন পর এসে সেই ছাত্র খুন হয়েছে বলে মামলা হয়েছে। এ মামলাকে কেন্দ্র করে দুই জেলার তিন উপজেলার ২১ জনকে আসামি করে চলছে ব্যাপক চাঁদাবাজী। এমন অভিযোগ উঠেছে যশোর সদর উপজেলার নেতা পরিচয় দানকারী কয়েকজনের বিরুদ্ধে।
তথ্য মিলেছে, ২০২৩ সালের ২৫ মার্চ শিক্ষকের সাথে মোটরসাইকেলে কোচিং-এ যাওয়ার সময় ট্রাক্টর চাপায় নিহত হয়েছিলো সুবর্ণসারা গ্রামের নবম শ্রেনীর ছাত্র তারিফ হোসেন। এ ঘটনায় সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করেছিলেন তারিফের মামা মোজাফ্ফর হোসেন। এমনকি টাক্টর টলির চালককে আটকও করেছিলো র্যাব। পরবর্তিতে বিষয়টি আপোষ মিমাংসা করে নিয়েছিলেন তারিফের মামা।
কিন্তু এক বছর নয়মাস পর সে ঘটনাকে পুঁজি করে এবার আদালতে হত্যা মামলা করেছেন তারিফের চাচা টিপু সুলতান। এ মামলায় ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ, যশোর সদর, বাঘারপাড়া ও চৌগাছা উপজেলার ২১ জনকে আসামি করেছেন। আর এ হত্যা মামলাকে প্ূঁজি করে তারিফের চাচার নেতৃত্বে একটি চক্র ব্যাপক অর্থবাণিজ্যে নেমেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ চক্রের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের কাঠামারার আনোয়ার হোসেন ইদু, আন্দোলপোতার পলাশ, কাঠামারার চকমআলীসহ অনেকেই। তারা নিজেদেরকে লেবুতলা ইউনিয়ন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী দাবি করে এসব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন।
গত কয়েকদিনের সরেজমিন অনুসন্ধানে গ্রামের কাগজ টিমের কাছে এসব মানুষের আর্তনাদের কথা তুলে ধরেছেন ভুক্তভোগীরা। ওই চক্রকে মনগড়া অর্থ না দেয়ায় অনেকে গ্রামছাড়া, আবার কেউ কেউ হত্যার হুমকি নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা অভিযোগ করেছেন, এ বিষয়ে আইনী সহায়তা চেয়েও কোনো ফল পাননি।
রোববার দুপুর ১২ টায় গ্রামের কাগজ টিম যায় ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার সূবর্ণসারা গ্রামে। কথা হয় তারিফের শিক্ষক মাহাবুর রহমানের সাথে। তিনি জানান, তারিফকে সকালে তিনি নিজ বাড়িতে পড়ান। পরে তার সাথে কোচিং এ যেতে চায়। যা তারিফের মাও জানেন। যাওয়ার পথে ৯টা ৪৫ মিনিটে সুবর্নসারার বরংপুকুর শ্মশানের অদুরে যেয়ে ট্রাক্টর টলির সাথে সংঘর্ষ হয়। ঘটনাস্থলেই তারিফ মারা যায়। তিনি নিজেও আহত হন। হাসপাতালেও ভর্তি ছিলেন। এটা কোনো হত্যার ঘটনা না, সড়ক দুর্ঘটনা বলেই জানান তিনি।
এসময় প্রত্যক্ষদর্শীরাও জানান একই কথা। তারা জানান, মুলত ওভারটেক করতে যেয়েই সংঘর্ষের ঘটনাটি ঘটেছিলো। এক অনুসন্ধানে উঠে আসে, এ ঘটনায় পরের দিন তারিফের মামা কালীগঞ্জের ফুলবাড়ী গ্রামের মুজাফফর হোসেন বাদী হয়ে ওই ট্রাক্টর ট্রলির ড্রাইভার চৌগাছার আড়পাড়া কান্দি গ্রামের সুকুমারের ছেলে মিথুনের বিরুদ্ধে কালীগঞ্জ থানায় মামলা করেন। ঘটনার প্রায় দুই মাস পর ২২ মে রাত আটটায় ঝিনাইদহ র্যাবের একটি টিম নিজ বাড়ি থেকে মিথুনকে আটক করে।
মামলাটি তদন্ত করে এসআই মহিদুল ইসলাম আদালতে চার্জশিটও জমা দেন। আটকের ১২ দিনের মাথায় মামা মোজাফফর আদালতের মাধ্যমেই মিথুনের সাথে আপোষ মিমাংসা করে নেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, মুলত মাহাবুর রহমান নিয়ন্ত্রন হারিয়ে পেছন দিক থেকে ওই ট্রাকটরকে আঘাত করে। এসময় তার ভাগ্নে মারা যায়। সেখানে ট্রাক্টর টলির ড্রাইভার মিথুনের কোনো দোষ ছিলো না। তিনি ভুল বুঝে মামলাটি করেছেন বলে উল্লেখ করেন। এখানেই চুকে যায় তারিফের মামার মামলার পাট।
তবে একই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এবার মাঠে নেমেছেন নিহত তারিফের চাচা সুবর্নসারা গ্রামের বিএনপি নেতা পরিচয়ধারী টিপু সুলতান। তিনি এ ঘটনাকে পূঁজি করে ঘটনার প্রায় দুই বছর পর গত ২ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ আদালতে ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ওই মামলার আসামিরা হলেন উপজেলার সূবর্ণসারা, জগন্নাথপুর, যশোর সদর উপজেলার বলেশ^রপুর, দলেনগর, গোবরা, বাঘারপাড়া উপজেলার পুকুরিয়া, চৌগাছার আড়কান্দি গ্রামের মানুষ। তাদের মধ্যে রয়েছেন কয়েকজন কলেজ শিক্ষক, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সাবেক জনপ্রতিনিধি, দিনমজুরসহ অনেকেই।
এছাড়া এরমধ্যে কয়েকজন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও রয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে তাদের কাছ থেকেই টিপুচক্র মোটা অংকের টাকা দাবি করছেন। না দিলে করছেন জুলুম নির্যাতন। এছাড়া এ মামলায় ফাঁসানোরও হুমকি দিচ্ছেন আসামি ছাড়া অন্যদেরও।
মুলত ৫ আগস্টের পর থেকেই এ চক্রের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে যশোর সদর উপজেলার একাংশ ও ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের একাংশের মানুষ। আনোয়ার হোসেন ইদু পেশায় কারারক্ষী হলেও চাকরির পাশাপাশি করছেন নানা অপকর্ম। টিপু ও ইদু মিলে চালাচ্ছেন চাচা-ভাইপো সিন্ডিকেট।
স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, গত ২৫ আগস্ট রাত আটটায় টিপু, ইদু, পলাশ, কাঠামারার রিয়াজুল ইসলাম হৃদয়, ইয়ামিন, বলেম্বরপুর কাঠামারার আশানুর রহমান, দেলোয়ারসহ আরও সাত আটজন যশোর সদর উপজেলার আন্দোলপোতা গ্রামের আক্কাস আলীর বাড়িতে আকস্মিক হামলা চালায়।
এসময় আক্কাসের কাছে চার লাখ টাকা চাঁদাদাবি করে তারা। ইদুর নির্দেশে তার মাথায় পিস্তল ঠেকায় টিপু। টাকা না দিলে ঘরে আগুন জালিয়ে দেবে, এমনকি আক্কাসকে হত্যা করা হবে এমন হুমকি দিয়ে চলে যায়। এরপর থেকেই আক্কাসহ তার ভাইয়েরা সবাই বাড়ি ছাড়া। এছাড়া আক্কাসের সাথে থাকা সাহেব আলীও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, এ চক্র গত এক মাসের ব্যবধানে আন্দোলপোতা গ্রামের শরিফুল গাজীর কাছ থেকে দুইলাখ টাকা, রিপন সরদারের কাছে ৮০ হাজার টাকা, আমান আলীর কাছথেকে একলাখ, দলেননগর গ্রামের ব্যবসায়ী সরোয়ারের কাছথেকে দুইলাখ টাকা জোর করে আদায় করেছেন। শুধুই আক্কাস আলী না, এ চক্রের ভয়ে আত্মগোপনে বসবাস করছেন আন্দোলপোতা গ্রামের কয়েকজন।
গত ১৫ আগস্ট এ চক্রের অন্যতম সদস্য আন্দোলপোতার সাক্কার আলী, রিয়াজুল ইসলাম হৃদয়, পলাশসহ একদল সন্ত্রাসী এক দম্পতির বাড়িতে যেয়ে মোটা অংকের চাঁদাদাবি করে। অন্যথায় নানা ধরণের হুমকি ধামকি দেয়। এরপর থেকেই নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এ দম্পতি। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ দিতে গেলে এ চক্রের প্রভাবে কাজ হয়নি বলে অভিযোগ করা হয়।
সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে করা হত্যা মামলার আসামি আন্দোলপোতার শহীদ, বলেম্বরপুরের মহিদুল, জামাত আলী, পুকুরিয়ার ইনামুল কাজী, দলেন নগরের হবিবার, গোবরার স্বপন মিত্রিসহ অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার কেউ কেউ মোটা অংকের টাকা মাসিক মাসোয়ারা দিয়ে বাড়িতে রয়েছেন।
এ বিষয়ে গ্রামের কাগজ টিম যায় সূবর্ণসারার নিহত তারিফের বাড়িতে। এসময় তারিফের দাদা আতিয়ার বিশ^াসও স্বীকার করেন তারিফ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। মামলার বাদী টিপু সুলতানকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি।
মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ করেও কথা বলেননি। গ্রামের কাগজ টিম যায় কুষ্টিয়া কারাগারে কর্মরত কারারক্ষী আনোয়ার হোসেন ইদুর বাড়িতে। তাকেও পাওয়া যায়নি। তবে, স্ত্রী জানান তিনি যশোরেই রয়েছেন। ছুটিতে রয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না তিনি ছুটিতে নেই। ডিউটির মধ্যেই যশোরে এসেছেন। পরে ইদুর নাম্বারে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে লেবুতলা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন দেলু জানান, তারা কেউই বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত না। তার কাছেও এসব বিষয়ে নানা অভিযোগ এসেছে। এ বিষয়ে দল থেকে দ্রুতই পদক্ষেপ নেয়া হবে।