ল্যাটিন আমেরিকার দুর্গম এলাকা হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা করছেন কিছু বাংলাদেশি। দালালের মাধ্যমে বন-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে। দালালের ভাষায় এ ভিসার নাম টানজান ভিসা। দেশের ১৩ জেলার লোকজন টারজান ভিসার ফাঁদে আটকা পড়ছেন প্রতারক চক্রের। সিআইডি জানিয়েছে, এসব এলাকায় মানব পাচারকারী খুবই সক্রিয়।
তারা ওইসব জেলাগুলোতে একাধিক অফিস খুলে বসেছে। তৈরি করেছে নিজেদের মতো করে একটি মানচিত্র। তাদের মাধ্যমে যারা আমেরিকায় গেছে তাদের নাম ও বায়োডাটা রেখেছে তারা। তাদের দেখিয়ে মানব পাচারকারীরা প্রেরণা দেয়, ওমুক ব্যক্তি এভাবে বিদেশে গেছেন। তারাও পারবেন।
তাদের এমন প্রতারণায় পড়ে সম্পত্তি বিক্রয় করে লাখ লাখ টাকা দিয়েছেন দালালদের। অবৈধ পথে বিদেশ যেতে অনেক ব্যক্তি জীবন হারাচ্ছেন। কেউ জীবন নিয়ে দেশে ফিরলেও নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। যে ১৩টি জেলায় চক্রটি বিস্তার লাভ করেছে সে জেলাগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, মানিকগঞ্জ, ভোলা, জামালপুর ও ময়মনসিংহ।
মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা কিছু শিক্ষিত ও স্মার্ট লোকদের বিদেশে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের তাদের করা মানচিত্র দেখিয়ে বলেন যে, এই দেশ থেকে এতো কিলোমিটার পথ পার হলে ওই দেশে যাওয়া যায়। এই সীমান্ত এলাকাটি উন্মুক্ত। কোনো সীমান্তরক্ষী এখানে দায়িত্ব পালন করেন না। অথবা বিদেশগামীদের বলা হয়, দুই দেশের মাঝে একটি ছোট জঙ্গল আছে। এটি পাড়ি দিলেই আমেরিকা যাওয়া যায়।
এছাড়াও বলা হয়, কানাডার ও আমেরিকার মাঝামাঝিতে একটি নদী আছে। সেটি পাড়ি দিলেই আমেরিকা যাওয়া যায়। এমন সব ভ্রান্ত কথা বলে বিদেশগামীদের প্রলোভনে ফেলে তারা লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। পুলিশ অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সিরিয়াস ক্রাইম শাখার এসপি মো. সাইদুর রহমান খান মানবজমিনকে জানান, ‘মানব পাচারকারী চক্র বিদেশগামীদের একেক সময় একেক প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে যেতে উদ্বুদ্ধ করে।
অনেকেই তাদের ফাঁদে পা দিয়ে মানব পাচারের দুর্গম ট্রানজিট পয়েন্টগুলোতে জীবন হারাচ্ছেন। কেউ অর্থ ও সব হারাচ্ছেন। সিআইডির সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে বেড়েছে মানব পাচার। পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় মানব পাচার ভয়ঙ্কর মাত্রা ধারণ করেছে। বাংলাদেশে মানব পাচারে নারী ও শিশুদের সংখ্যা বেড়েছে। যা ৫০ শতাংশের বেশি। পাচার হওয়াদের মধ্যে পুরুষ ৪৯ শতাংশ, নারী ৩৬ শতাংশ এবং শিশু ১৫ শতাংশ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পাচারের শিকার মানুষ রয়েছে ভারতে। সূত্র জানায়, ওই ১৩টি জেলায় মানব পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু ব্যক্তি তাদের সহযোগিতা করছে। ওই চক্রটি তাদের প্রতিষ্ঠানের পেছনে কে আছে এবং সরকারি কোনো নিয়মনীতি মেনে চলেন কি-না তা তারা বিদেশগামীদের দেখান। যাওয়ার আগে অর্ধেক টাকা এবং পরে অর্ধেক টাকা নেয়া হবে বলে বিদেশগামীদের বিশ্বাস অর্জন করেন তারা।
পরে চক্রটি বিদেশগামীদের পাচারের প্রধান রুটে নিয়ে যায়। সূত্র জানায়, পাচারের জন্য তাদের প্রথমে মেক্সিকোতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে তারা এক চক্রের কাছে তাদের হাত বদল করে। পরে ওই চক্রটি তাদের পাচারের শিকার হওয়াদের কাছে টাকা দাবি করে। না হলে তাদের সীমান্ত পাড়ি দেয়ার রুট দেখিয়ে দিবে না বলে জানায়। টাকা না দিলে তাদের এক ধরনের জিম্মি করে ফেলে। চলে নানারকম নির্যাতন। তাদের সঙ্গে মুঠোফোনে পরিবারের কথা বলিয়ে দেয়া হয়।
ভিকটিম তখন কান্নাকাটি করে জীবন বাঁচানোর জন্য পরিবারের কাছে আকুতি জানান। সূত্র জানায়, পরিবারের সদস্যরা বাধ্য হয়ে ঋণ করে বা সম্পত্তি বিক্রি করে তাদের হুন্ডি অথবা অন্য চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠায়। ওই টাকা পাওয়ার পর তারা আবার দ্বিগুণ টাকা দাবি করে। টাকা পাওয়ার পর তারা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ সময় নিরুপায় হয়ে ওই দেশের কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে তারা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সীমান্তে কঠোর নজরদারির কারণে অনেকেই ওই দেশে আর যেতে পারেন না।
আপনার মতামত লিখুন :