হালনাগাদের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ তালিকা নির্দেশনা উপেক্ষিত


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুলাই ১৮, ২০২২, ৬:৪৪ পূর্বাহ্ণ /
হালনাগাদের অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ তালিকা নির্দেশনা উপেক্ষিত

সারা পৃথিবীতেই সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব দিনে দিনে বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে জীবন বাঁচাতে সব ধরনের ওষুধের প্রয়োজনীয়তাও। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। তবে সমস্যা হলো, এ দেশে জীবনরক্ষাকারী এই ওষুধগুলোর দাম নিয়ন্ত্রণে নেই সরকারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। প্রয়োজনীয় ওষুধের তালিকা দীর্ঘ হলেও বর্তমানে দেশে মাত্র ১১৭টি ওষুধ অত্যাবশ্যকীয় তালিকার আওতাভুক্ত। জাতীয় ওষুধনীতি ২০১৬-তে বলা হয়েছে, নিয়মিতভাবে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা হালনাগাদ করা হবে। কিন্তু ওষুধনীতির সেই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। তাই সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এসেনশিয়াল ড্রাগ লিস্ট হলো, একটি জনগোষ্ঠী বা দেশের জন্য তৈরিকৃত অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা। যাতে ওই জনপদ বা

গোষ্ঠী বা দেশে সচরাচর যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, সেই রোগগুলোর জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ওষুধ লিপিবদ্ধ থাকে। জানা গেছে, বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৮৯টি। এর মধ্যে কয়েকটির উৎপাদন কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান ৩৯৪৭টি জেনেরিকের ৩২ হাজার ৫৫০টি ব্র্যান্ডের ওষুধ তৈরি ও বাজারজাত করছে। এর মধ্যে মাত্র ১১৭টি ওষুধ অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় রয়েছে। সেগুলোর বাদে বাকি সব ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ হয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ইচ্ছায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে অনেক মানুষ বিভিন্ন ধরনের রোগে ভোগেন। জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা, নাক বন্ধ, ডায়েরিয়া ইত্যাদি রোগের ওষুধ অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় থাকলেও ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, কিডনি ইত্যাদি মরণব্যাধির ওষুধ এই তালিকায় নেই। অথচ এসব রোগের কারণে বছরে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। তাই এসব রোগের ওষুধও অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় থাকা এখন সময়ের দাবি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জনস্বাস্থ্যবিদ ও দেশের প্রথম ওষুধনীতি প্রণয়নকারী চিকিৎসক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘শতভাগ ওষুধই অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় রাখা উচিত। কারণ প্রত্যেকটি ওষুধই কারও না কারোর জন্য অত্যাবশ্যকীয়।’

একটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘স্বাধীনতার পরে ওই কোম্পানির বার্ষিক বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩৪ লাখ টাকা। অথচ বর্তমানে প্রতি মিনিটে তাদের বিক্রি ২৬ লাখ টাকা। যে মানুষটি হৃদরোগে বা কিডনি জটিলতায় অথবা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত- তার জন্য ওই রোগের ওষুধগুলো অত্যাবশ্যকীয়। তাই সব ওষুধই এই তালিকায় রাখা উচিত। তা হলে সব ওষুধের মূল্যই সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।’ এক্ষেত্রে ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

জানা গেছে, ১৯৮২ সালের ওষুধনীতিতে অত্যবশ্যকীয় তালিকায় ১৫০টি ওষুধের নাম অন্তর্র্ভুক্ত করা হয়। পরে যা ১১৭টিতে নেমে আসে। এরপর ২০১৬ সালে নতুন করে জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়ন করা হলে সেখানে বলা হয়, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের ধারণার ওপর ভিত্তি করে নিয়মিতভাবে এই তালিকা হালনাগাদ করা হবে। একই বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা বাড়িয়ে ২৮৫টিতে উন্নীতের প্রস্তাব করা হয়। তবে সেই তালিকা এ নো প্রস্তাবনায় রয়ে গেছে।

এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আইয়ুব হোসেন বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় ২৮৫টি ওষুধ অন্তর্র্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছিল। সেগুলো তালিকাভুক্ত হয়েছে। তবে সরকারিভাবে শুধু ১১৭টি ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ওষুধনীতি ২০১৬ অনুসারে এই তালিকা বাড়ানো হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কখনো এমন প্রস্তাব এলে বিবেচনা করা হবে।

২০২১ সালের ১০ মার্চ প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে দেশে কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে ২৮ হাজার ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। স্ট্রোকের শিকার হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৮৫ হাজার ৩৬০ জনের। যা আগের বছর ছিল ৪৫ হাজার ৫০২। চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বাংলাদেশে এখন প্রায় ২০ লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত। প্রতি বছর আরও প্রায় এক থেকে দেড় লাখ মানুষ নতুন করে এই অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। মৃত্যুও হয় লাখের কাছে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির তথ্য মতে, দেশে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি। যারা নিয়মিত চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এর পাশাপাশি কোভিড ১৯-এর মতো সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব তো আছেই। সব মিলিয়ে ওষুধ দাম দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হলে এসব রোগের ওষুধ অত্যাবশকীয় তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, অত্যাবশ্যকীয় তালিকায় আরও অনেক ওষুধ যুক্ত করতে হবে। প্রায় ৩০ বছর আগে ১১৭টি ওষুধের যে তালিকা করা হয়েছে, তা দিয়ে এখনো চালানো হচ্ছে। অথচ এই সময়ে আরও অনেক ওষুধ অতি জরুরি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বেড়েছে নানা ধরনের রোগব্যাধি। তাই সরকারের উচিত, এখন প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ওষুধের তালিকায় কমপক্ষে দুইশ থেকে তিনশ ওষুধ যুক্ত করা। অতি জরুরি এসব ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে এগুলোর কাঁচামাল দেশে উৎপাদনের ব্যাপারেও তাগিদ দেন তিনি।