কোভিড মহামারী ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে জ্বালানিসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। কমছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। এর মধ্যে আবার বাড়ানো হয়েছে অতিপ্রয়োজনীয় ওষুধের দামও। স্বাস্থ্যসেবার মূল্যও উর্ধ্বমুখী। যেখানে চিকিৎসাসেবার ৬৮ শতাংশ অর্থ জনগণকে নিজের পকেট থেকে দিতে হয়, সেখানে ওষুধের দাম ‘মাত্রাতিরিক্ত’ বাড়ায় দেশের স্বাস্থ্যসেবা মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সেবা নিতে গিয়ে ব্যক্তি যে আর্থিক চাপে পড়ছে, তার সঙ্গে জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দের সম্পর্ক আছে। বহুদিন ধরে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ একই ধারায় চলছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় কম। স্বাস্থ্য ব্যয় সাধারণের নাগালের মধ্যে আনতে হলে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ওষুধের অপচয় বন্ধ করতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যয় কমাতে নিতে হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণায় বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজের পকেটের ব্যয় বেড়েই চলেছে। এখন যে ব্যয় হয়, তার প্রায় ৬৮ শতাংশ ব্যক্তি নিজে বহন করেন। এই ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে প্রতিবছর ৮৬ লাখের বেশি মানুষ আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছেন। ব্যয় বেশি হওয়ায় ১৬ শতাংশ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবা নেয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ওষুধের দাম বাড়ায় মানুষের ব্যয় আরও বাড়বে। ফলে আগে মানুষ চিকিৎসার জন্য যে টাকা ব্যয় করতেন, এখন সেটা করতে পারবেন না। এতে করে সাধারণ মানুষের ন্যূনতম চিকিৎসা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়বে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের ‘স্বাস্থ্য অর্থায়ন কৌশলপত্রে’ বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমিয়ে ৩২ শতাংশে আনা হবে। কৌশলপত্র প্রণয়নের সময় (২০১২ সালে) স্বাস্থ্য ব্যয়ে ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় হতো ৬৪ শতাংশ। এর মধ্যে সরকার বহন করত ২৬ শতাংশ, আর অন্যান্য উৎস থেকে আসত ১০ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ নিশ্চিত করতে হলে ব্যক্তির ওপর স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা ব্যয়ের চাপ কমাতে হবে। তবে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় উল্টো বেড়েছে। ২০১৫ সালে ব্যক্তির ব্যয় ৬৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৭ শতাংশ হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণায় দেখা যায়, ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় আরও কিছুটা বেড়ে ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে।
গবেষকরা দেখিয়েছেন, ব্যক্তির সিংহভাগ টাকা চলে যায় ওষুধ কিনতে। ব্যক্তির ব্যয়ের অন্য খাতটি হাসপাতাল। ১২ শতাংশ টাকা ব্যয় হয় হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে। হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে সেবা নিতে ১১ শতাংশ ব্যয় হয়। অন্যদিকে ৮ শতাংশ ব্যয় হয় ল্যাবরেটরির পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এক্স-রেসহ নানা ধরনের সেবার পেছনে। বাকি ৫ শতাংশ অর্থ চলে যায় স্বাস্থ্যসেবায় জড়িত পেশাজীবীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের পেছনে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট জানায়, দেশের ১৪ দশমিক ৪১ শতাংশ মানুষ সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে যায়। এর মধ্যে আছে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র (৫.২২ শতাংশ), উপজেলার নিচের পর্যায়ে (৩.৬৬ শতাংশ), জেলা হাসপাতাল ও মাতৃসদন (৩.৫৭ শতাংশ), মেডিক্যাল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতাল (১.৮৭ শতাংশ) এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে দশমিক ০৯ শতাংশ। অর্থাৎ দেশের ৮৬ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নেয় বেসরকারি খাত থেকে। এর মধ্যে এনজিও পরিচালিত প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নেয় ১ শতাংশের কম মানুষ। সবচেয়ে বেশি মানুষ সেবা নেয় ‘অপ্রাতিষ্ঠানিক’ সেবাদানকারীদের কাছ থেকে। ৬০ শতাংশ মানুষ এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে আছে ওষুধের দোকান, হাতুড়ে চিকিৎসক। ব্যক্তি নিজেও অনেক সময় নিজের চিকিৎসা করেন বা ওষুধ কিনে খান। বেসরকারি খাতের মধ্যে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্ব^ার থেকে চিকিৎসা নেয় ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ মানুষ। বাকি ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ মানুষ চিকিৎসা নেয় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন করতে হলে ব্যক্তিকে তার প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। ব্যয় বেশি হওয়ায় মানুষ যেন সেবা নেওয়া থেকে বিরত না থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে দেশের ১৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার, ক্লিনিক বা কোনো চিকিৎসকের কাছে যায় না। অন্যদিকে আয়ের তুলনায় চিকিৎসা ব্যয় বেশি হওয়ায় ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার এক ধরনের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। সাড়ে ৪ শতাংশ পরিবার বা ৮৬ লাখ মানুষের অর্থনৈতিক শ্রেণির পরিবর্তন ঘটে। যারা মধ্যবিত্ত তারা নিম্নবিত্তে এবং যারা নিম্নবিত্ত তারা দরিদ্র শ্রেণিতে পরিণত হয়।
এমন পরিস্থিতে সরকার অতিপ্রয়োজনীয় ৫৩টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। সাধারণ রোগবালাই থেকে মুক্তি পেতে চিকিৎসকরা এসব ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এমনকি সাধারণ মানুষ দোকান থেকে এসব ওষুধ কিনে নিজেদের সুস্থ রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যয় বাড়ার কারণে এখন সাধারণ মানুষকে ওষুধ কেনার ক্ষেত্রেও অনেক চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম, ‘চিকিৎসায় বড় অংশই ওষুধ কেনার পেছনে ব্যয় হয়। অনেকের মাসিক ওষুধের ব্যয় অনেক বেড়েছে, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে নির্বাহ করা অনেকটা অসম্ভব। এ ছাড়া এক শ্রেণির চিকিৎসক অপ্রয়োজনে ওষুধ লেখেন। এতে শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। দাম বাড়ার কারণে ওষুধের পুরো কোর্স সম্পন্ন করার সক্ষমতা অনেকে হারাবে। আর এটা দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের চাপ।
আপনার মতামত লিখুন :