ফ্যাসিবাদের দানব হারুনের কাসুন্দি!


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : অক্টোবর ১১, ২০২৪, ৭:৩৯ পূর্বাহ্ণ /
ফ্যাসিবাদের দানব হারুনের কাসুন্দি!

নাটক সিনেমার নায়কের চেয়েও তিনি ছিলেন বেশি প্রচারমুখী। নায়িকা-শিল্পীরা তার কাছে ঘুরঘুর করতেন। কিন্তুদেশবাসীর কাছে তিনি হাসিনার লাঠিয়াল, খলনায়ক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বে (সরকারি চাকরি) থাকার সময় তিনি ছিলেন ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর, চরিত্রহীন লম্পট। তিনি যে কত মানুষের উপর নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন, কত রাজনীতিক, সাবেক মন্ত্রী-এমপিকে অপদস্ত করেছেন তার সীমা-পরিসীমা নেই। জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিপ হুইপকে পিটিয়ে পদক ও পদোন্নতি হওয়ার পর তার ঐদ্ধত্য আরো কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। দায়িত্ব পালনের নামে অপকর্মে সীমা অতিক্রম করেন তিনি।

বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের নির্যাতন ও হয়রানি করতে তার জুড়ি পরিসীমা ছিল না। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের মতো ভয়ঙ্কর গডফাদারের সঙ্গে পাঙ্গা দিয়ে সফল হয়েছেন। এতক্ষণ যার কথা বলা হলো তিনি ডিএমপির একটি গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান হারুন-অর-রশীদ। তিনি ভাতের হোটেলের হারুন নামে সর্বাধিক পরিচিত। কিলার হারুন এখন পলাতক। পুলিশ তাকে খুঁজছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা না পড়লেও তিনি ‘নাগরিক টিভি’ নামের ইউটিউব চ্যানেলের সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তার এই সাক্ষাৎকার প্রচারের পর তিনি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। তাকে নিয়ে নানান বক্তব্য-মন্তব্য-বিতর্ক করছেন নেটিজেনরা।

সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার নির্দেশে গণহত্যাকে তিনি ‘অপরাধ’ মনে করেননি। ছাত্রলীগের সাবেক ক্যাডার হারুন বিগত সরকারের শাসনামলে ছিলেন শেখ হাসিনার সবচেয়ে আস্থাভাজন। তিনি দাবি করে বলেন, আমি যা করেছি ন্যায়বোধ থেকে করেছি; অন্যায় করিনি। ন্যায়বোধ দিয়ে কাজ করায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়েছি। মানুষ আমার কাজের প্রশংসা করেছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, গণপিটুনির ভয়েই তিনি আত্মগোপনে। বলেন, এখন মানুষকে (মন্ত্রী-এমপি-আওয়ামী লীগ নেতা) ধরে যেভাবে পেটানো, ডিম মারা হচ্ছে। যদি আমাকে পেটায়, ডিম মারে? আগে তো বাঁচতে হবে।

পুলিশের আইজিকে গণভবনে যেতে অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন হলেও তিনি শেখ হাসিনার কাছে যেতে পারতেন অনায়াসে। পুলিশের মধ্যসারির এই কর্মকর্তার অবস্থা ছিলে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামরে এসপি মাহবুবের মতোই। এসপি মাহবুবের নাম মনে আছে? অর্ধশত বছর আগে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মাহাবুব আলম (বীরবিক্রম)। এসপি মাহবুব নামে পরিচিত ছিলেন। শেখ কামাল ও মেজর (অব) শরিফুল হক ডালিমের বন্ধু ছিলেন। শেখ মুজিবের নির্দেশে কমরেড সিরাজ সিকদারকে প্রথম ক্রসফায়ারে হত্যা করেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে সেনাপ্রধান ও পুলিশের আইজিপিকে আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে যেতে হতো। এসপি মাহবুবের সে সবের বালাই ছিল না।

টিভি সাক্ষাৎকারে হারুন-অর-রশীদ দাবি করেছেন, তিনি পুলিশের ছোট অফিসার ছিলেন, যা করেছেন উপরের নির্দেশে করেছেন। তিনি মানুষের ভালো করার জন্য সব কিছু করেছেন। তবে কিছু কিছু কাজ তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন। হারুন দাবি করেন ছাত্র-জনতার হাতে গণধোলাই এবং পুলিশ সদর দফতরের দেয়াল টপকে পালাতে গিয়ে ব্যথা পাওয়ার বিষয়গুলোকে গুজব। তিনি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর কাজে যোগদানের জন্য অফিসে যেতে চেয়েছিলেন।

২০১১ সালের ৬ জুলাই বিএনপির হরতালে চলছিল বিরোধী দলীয় চিপ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের নেতৃত্বে সংসদ সদস্যরা মানিক মিয়া এভিনিউয়ের সামনে মিছিল করলে তৎকালীন তেজগাঁও বিভাগের সহকারী উপকমিশনার হারুনুর রশিদ আক্রমণাত্মকভাবে জয়নুল আবেদিন ফারুকের উপর হামলা চালান। তার গেঞ্জি ছিঁড়ে ফেলেন এবং মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করেন। বিরোধী দলের একজন চিপ হুইপের উপর এমন ন্যক্কারজনক হামলা নিয়ে তখন সমালোচনার ঝড় উঠে। এ জন্য তিনি পুলিশ পুরস্কারও পেয়েছিলেন। সে সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীর স্বীকার করেছিলেন সংসদের চিফ হুইপকে পেটানোর সাহসিকতার জন্য পুরস্কার দেয়া হয়।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে তিনি অনেক বিতর্কের জন্ম দেন। নারায়ণগঞ্জের এসপি থাকার সময় ওই জেলার সন্ত্রাসের গডফাদার নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের এমপি শামীম ওসমানেকে নাকানি চুবানি দেন। এমনকি পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাশেমের ছেলে শওকত আজিজ রাসেলের স্ত্রী ও পুত্রকে তুলে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণের মতোই চাঁদাবাজি করেন। এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হলে তাকে বদলি করা হয়। নাগরিক টিভির ওই সাক্ষাৎকারে সুচতুরভাবে এসব প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকেন সুবিধাভোগী সাংবাদিক। বোঝা যায়, হারুন নিজেই বিদেশে পালিয়ে গিয়ে নিজেই এই গণমাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরার আয়োজন করেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করা হারুন উর রশিদকে ৫ আগস্টের পর মারধরের ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। মারধরের বিষয়ে জানতে চাইলে হারুন বলেন, ‘ফেসবুক, ইউটিউবে নানা গুজব আছে। আপনারা মরার ছবিসহ নানা গুজব দেখেছেন। আমি এগুলো নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। যারা এগুলো বলে তারা গুজব বা টাকা-পয়সা পাওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাড়ে। এগুলো গুজব।’
পুলিশ সদর দফতরের দেয়াল টপকে পালাতে গিয়ে ব্যথা পাওয়ার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমি পুলিশ সদর দফতরে যাইনি।’

হাসিনার লাঠিয়াল পলাতক হারুন বলেন, ‘আমাকে নিয়ে মিডিয়াতে তো প্রতিদিন একেক রকম খবর আছে। কাল দেখলাম এক অনলাইনে আসছে, আমি আর আমার বউ নাকি আছি ভাটিরচর। একটায় দেখলাম আমি নাই। আবার এক জায়গায় দেখলাম, আমি আছি কারো হেফাজতে। আবার আরেকটায় বলেছে, আমি অন্য জায়গায় চলে গেছি। গতকাল আবার দেখলাম র‌্যাব বলেছে, আমি নাকি তাদের হেফাজতে আছি। একেকজন একেক ধরনের কথা বলছে। আমি আসলে কারো সঙ্গে কথা বলি না। আমি বলছি, আমি আছি, আমি সেইফ আছি।’ এ সময় তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি কোথায় আছেন? জবাবে হারুন বলেন, আমার নিরাপত্তার কারণে আমি আসলে বলতে চাচ্ছি না। তবে আপনি হয়তো জানেন যে, লিগ্যালি এই সময় কোথাও (যুক্তরাষ্ট্র, সেখানে তার স্ত্রী-সন্তান থাকেন) যেতে গেলে তো, কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। লিগ্যালি আমার যাওয়া কি সম্ভব?

ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকাতে গণহত্যা নিয়ে অনুতপ্ত নেই হাসিনার লাঠিয়াল সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা হারুনের। তিনি বলেন, ‘আমি পুলিশ বাহিনীতে লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করিনি। আমি সরকারি চাকরি করি। আমার সঙ্গে কোনো দিন শেখ হাসিনার দেখা হয়নি। ১৫ বছরের ক্ষমতাকালীন সময়ে কোনো দিন শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। আমার সঙ্গে কথা হয়নি। আমাকে বলা হচ্ছে হুকুমদাতা। আমি হুকুমদাতা কীভাবে হলাম। আমি তো ডিএমপি কমিশনারের অধীনে কাজ করেছি। আমি যা করেছি ন্যায়বোধ থেকে করেছি; অন্যায় করিনি। ন্যায়বোধ দিয়ে কাজ করায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়েছি। কিন্তু মানুষ আমার কাজের প্রশংসা করেছে। আমাকে ভুল বোঝার অবকাশ নেই।’

হাসিনা পালনোর পর কাজে যোগদানের প্রসঙ্গে হারুন-অর-রশীদ বলেন, ‘আমাকে ঘিরে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছিল। তখনো আমি চুপ ছিলাম। সরকার যখন বলল, সবাইকে কাজে যোগ দিতে। তখন আমি গত ৮ আগস্ট ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি আমাকে তখনই যোগ দিতে নিষেধ করেন। আমাকে নিরাপদ স্থানে থাকতে বলেন। আমি যোগদান করতে গেছি। কিন্তু আমি যোগ দিতে পারিনি। দুদিন পর দেখি আমার নামে মোহাম্মদপুর থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি, কমিশনার ও আমাকে হুকুমের আসামি করা হয়। তখন আমি অবাক হলাম। আমি তো ডিবিতে কাজ করি।

ডিবির কাজ হলো মামলা তদন্ত করা। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নির্দেশ দিলে আমরা গ্রেফতার করি। মোহাম্মদপুরে তো আমি গিয়ে মারামারি করিনি, এটা তো আমার কাজ না। অতিরিক্ত কমিশনার কি মারামারি করতে যায়? আর ডিএমপিতে কমিশনারের পরে ছয়জন অতিরিক্ত কমিশনার। আমি হলাম ৬ নম্বর কমিশনার। সেখানে আমার নামে যখন মামলা হলো তখন তো একটু। আবার বলা হলো মামলা হলেও সমস্যা নেই। ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকলে গ্রেফতার করা হবে না। আমি মনে করলাম ভালো কথা। ভাবলাম জয়েন্ট করব। পরের দিন দেখলাম একজন উপদেষ্টা বললেন, যেসব পুলিশ কর্মকর্তা জয়েন্ট করেননি আপনারা তাদের ধরে নিয়ে আসেন। আমি তখন আরো অবাক হলাম। আমি যদি চাকরিতে জয়েন্ট না করি তাহলে প্রসিডিং করবে। আর যোগ দিলে আমাকে দিয়ে জোর করে চাকরি করাবেন। এটা শোনার পরে আমার মনে হলো রিস্ক। মানে আমার লাইফ ঝুঁকির মধ্যে। এখন মানুষকে ধরে যেভাবে পেটানো, ডিম মারা হচ্ছে। যদি আমাকে। আগে তো বাঁচতে হবে। আমি ইচ্ছাকৃতভাবে একটু চুপ আছি।’

৫ আগস্টের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি-ভিডিও ছড়ায়, যেখানে দাবি করা হয় ছাত্র-জনতার হাতে গণপিটুনি খেয়েছেন হারুন-অর-রশীদ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফেসবুক, ইউটিউবে নানা গুজব আছে। আপনারা মারার ছবিসহ নানা গুজব দেখেছেন। আমি এগুলো নিয়ে মন্তব্য করতে চাই না। পুলিশ সদর দফতরের দেয়াল টপকে পালাতে গিয়ে ব্যথা পাওয়ার বিষয়ে সাবেক ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি পুলিশ সদর দফতরে যাইনি।’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কে অন্যেরা গ্রেফতার করে তার কাছে দিয়েছিল দাবি করে তিনি বলেন, আমি কাওকে অ্যারেস্ট করেননি; বরং উপর মহলের আদেশে বিভিন্ন সংস্থা থেকে ছয় সমন্বয়ককে তুলে তার হেফাজতে রাখা হয়। কিন্তু তিনি কখনো কারোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি, তিনি তাদের খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। এই সময় তিনি সমন্বয়কদের সাথে তাদের স্বজনদেরও সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছেন। সাক্ষাতের পর সেই স্বজনরা ডিবি কার্যালয়ে দুপুরের খাবার খান, সে ভিডিও চিত্রও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন প্রচার করেছে।

দেশবাসী কেন আপনাকে ঘৃণা করে? এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, ‘আমি ১২ বছর চাকরি করেছি। আমার কোনো অন্যায় থাকলে আপনি আমাকে ছাড়তেন? তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? এখন আমি একটু অড পজিশনে পড়ে গিয়েছি, এখন যদি বলে হারুন খুব খারাপ তাহলে আমি কী খারাপটা করেছি বলেন। কার ক্ষতি করেছি? আমার কাছে যারাÑ যেসব আসামি ছিল… এমনো বড় বড় বিএনপি নেতারা আমার কাছে গিয়েছিল… তারা আমাকে বলত আমার ফ্যামিলি প্রবলেম আছে, আমার ফ্যামিলি প্রবলেম সলভ করে দিও। এসব বিষয়ে আমি আরেক দিন কথা বলব।’