নদী ভাঙনে বিলীয়ন হচ্ছে যুমনার বামতীর -সাবা
জামালপুরে দেওয়ানগঞ্জের ফুটানি বাজার থেকে সরিষাবাড়ী উপজেলার পিকনা পর্যন্ত প্রায় ২৬ কিলোমিটার এলাকা নদীভাঙন রোধে যমুনার বামতীর সংরক্ষণ প্রকল্প ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের নামে গত সাড়ে ১৫ বছর কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। সাড়ে ১৫ বছর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ছোট বড় শতাধিক প্রকল্পে বরাদ্দ এসেছে দেড় হাজার কোটিরও অধিক। যার বেশির ভাগ টাকা হয়েছে হরিলুট। এই টাকা হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার এমপি-মন্ত্রী এবং তাদের স্বজনদের বিরুদ্ধে।
জানা যায়, বিভিন্ন প্রকল্পের দরপত্র বা কার্যাদেশে ভিন্ন ভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হলেও কাজের নামে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করেছে এমপি-মন্ত্রী এবং তাদের স্বজনরা।
জামালপুর জেলার চারটি নির্বাচনী এলাকার বুক চিড়ে প্রবাহিত হচ্ছে যমুনা নদী। যমুনার তীরসংরক্ষণ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের নামে গত সাড়ে ১৫ বছরে ঘটেছে মহাসাগর চুরির ঘটনা। দুই মন্ত্রণালয়ের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে নদীর ভাঙন রোধের নামে।
জামালপুরের পাঁচটি নির্বাচনী এলাকার মধ্যে চারটি আসনের পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি-মন্ত্রী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ নিয়ে বেশির ভাগ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে ।
দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের বিভিন্ন সময় যমুনা তীর সংরক্ষণ, বাঁধ নির্মাণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ, ব্রহ্মপুত্র, দশআনী ও জিনজিরাম নদীসহ বিভিন্ন নদ-নদীর ভাঙন রোধের নামে সরকারি এসব টাকা জামালপুর-১ (দেওয়ানগঞ্জ-বকশীগঞ্জ), জামালপুর-২ (ইসলামপুর), জামালপুর-৩ (মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ) এবং জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনের এমপি-মন্ত্রী ও তাদের আত্মীয়-স্বজনরা।
জামালপুর পানি উন্নয়ন সূত্রে জানা যায়, এসব প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বৃহৎ প্রকল্প দেওয়ানগঞ্জের ফুটানি বাজার থেকে ইসলামপুর উপজেলার উলিয়া বাজার পর্যন্ত। যার বরাদ্দ প্রাথমিক বরাদ্দ ছিল ৬৬৪ কোটি টাকা। যেটি পর্যায়ক্রমে ৮০০ কোটিতে দাঁড়িয়েছে ।
জামালপুর-২ (ইসলামপুর) আসনের সাবেক এমপি সুলতান মাহমুদ বাবু বলেন, যমুনার বামতীর সংরক্ষণের নামে ৬৬৪ কোটি টাকার ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ যে প্রকল্প নেয়া হয়েছিল সেটিতে সীমাহীন দুর্নীতি করা হয়েছে। আত্মসাৎ করা হয়েছে বেশির ভাগ টাকা। যে কারণে বার বার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে এই অঞ্চলের মানুষ।
পার্থশী ইউনিয়নের শশারিয়াবাড়ি গ্রামের শফিকুল ইসলাম বলেন, নিম্নমানের কাজ করার কারণে প্রকল্পের বিভিন্ন স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। ওইসব স্থানে জরুরি ভাঙন রোধের নামে বিনা টেন্ডারে বালুর বস্তা ফেলে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
দ্বিতীয় বৃহৎ প্রকল্প মাদারগঞ্জ উপজেলার পাকেরদহ ইউনিয়নের পাকরুল থেকে বালিজুড়ী হয়ে জামথল পর্যন্ত ৬.৭৫ কিলোমিটার। এই প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৫৭৪ কোটি টাকা।
জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবোর) নির্বাহী প্রকৌশলী মো: নকিবুজ্জামান খান জানান, পাকরুল এলাকায় যমুনার বামতীর সংরক্ষণে ৬.৭৫ কিলোমিটার প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ আসেছিল ৫৭৪ কোটি টাকা। ৫০৫ কোটি টাকা চুক্তিমূল্যে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়া হয়। ইতোমধ্যে ৪৩৪ কোটি টাকার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, মাদারগঞ্জের পাকেরদহ ইউনিয়নের পাকরুল এলাকায় ৪৩৪ কোটি টাকার বালু ভর্তি জিও ব্যাগ ড্রম্পিং ও ভোল্ডার ফেলা হলেও অরক্ষিত রয়েছে ইসলামপুরের কাঠমা ও বগুড়ার সারিয়াকান্দী উপজেলার মানিকদারসহ বেশ কিছু এলাকা। কাজ চলাকালীন ওই তিনটি গ্রামের কয়েক শ’ ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে।জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবোর) নির্বাহী প্রকৌশলী মো: নকিবুজ্জামান খান নয়া দিগন্তকে বলেন, ৫০৫ কোটি টাকার মধ্যে ৪৩৪ কোটি টাকার কাজ করে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কাজ বন্ধ করে ৭১ কোটি টাকা ফেরত পাঠানো হয়েছে। জামালপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবোর) এই প্রকৌশলীর নিকট গত সাড়ে ১৫ বছরে জামালপুরে নদীভাঙন রোধে কতটি প্রকল্প বা কত হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে জানতে চাওয়া হয়।
এ ব্যাপারে তিনি তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন । তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার চাকরি বয়স সাত বছর। আমি সাড়ে ১৫ বছরের তথ্য দিবো কি করে। তবে তথ্য দিতে ১৫ মাস সময় চান জামালপুর পাউবোর এই নির্বাহী প্রকৌশলী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত সরকারের সাড়ে ১৫ বছের জামালপুরে যমুনার তীর সংরক্ষণ প্রকল্প, বন্যা নিয়ন্ত্রণবাঁধ এবং জরুরি নদীভাঙন রোধের নামে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের শতাধিক ছোট বড় প্রকল্পের ২০০০ কোটির অধিক টাকা বরাদ্দ এসেছে ।
এছাড়া বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের আড়াআড়ি বাঁশ পাইলিং, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে নদী খননের নামে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে। যার বেশির ভাগ আত্মসাৎ হয়েছে বলে অভিযোগ সচেতন মহলের।
জামালপুর দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক মানবাধিকারকর্মী জাহাঙ্গীর সেলিম বলেন, নদীভাঙন রোধের নামে সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে। এগুলোর তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত।
এলাকাবাসী প্রশ্ন নদীভাঙন রোধের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ এসেছে। যার বেশির ভাগ টাকা আত্মসাৎ করেছেন এমপি-মন্ত্রী ও তার আত্মীয়-স্বজনরা। তাদের অভিযোগ যমুনার ভাঙন রোধের নামে সাগরচুরি হয়েছে যমুনায়।
গত বর্ষা মৌসুমেও যমুনার ভাঙনে জামালপুরের ইসলামপুরের সাপধরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহ্ আলম মন্ডল বলেন গত বর্ষা মৌসুমে তার ইউনিয়নের চেঙ্গানিয়া, মন্ডলপাড়া, কাঁসারি ডোবা, আকন্দপাড়া, প্রজাপতি, চরশিশুয়া, শিশুয়া গ্রামের ৩-৪ শত ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়েছে।
বেলগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক বলেন, তার ইউনিয়নের সিন্দুরতলী, শিলদহ, পূর্ব মন্নিয়া, চর মন্নিয়া, গ্রামের ৪-৫ শ’ বসতবাড়ি ও বিস্তীর্ণ এলাকার শত শত একর ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়েছে।স্থানীয়রা জানান, এ বছরও নদী ভাঙনে জেলার দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার কয়েক হাজার পরিবারের ভিটামাটি ও ফসিল জমি নদীতে বিলীন হওয়ায় সহস্রাধিক পরিবার নিঃস্ব হয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :