পদ্মার ভাঙনে ফরিদপুর অঞ্চলের লাখ লাখ পরিবার গৃহহীন হয়ে গেছে


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪, ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ /
পদ্মার ভাঙনে ফরিদপুর অঞ্চলের লাখ লাখ পরিবার গৃহহীন হয়ে গেছে

ফরিদপুর অঞ্চল গিলছে পদ্মায়। দীর্ঘ ২৪ বছরের অব্যাহত নদী ভাঙনে লাখ লাখ পরিবার গৃহহীন। এর মধ্যে গত ১৭ বছরের নদী ভাঙনের কবলে পড়ে যারা গৃহহারা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই সরকারি ঘর পেয়েছে। কিন্তু সে লোকগুলো সবাই আওয়ামী সমর্থিত। টানা এই নদী ভাঙনে সর্বশেষ ফরিদপুর সিএন্ডবি ঘাটের বিপরীত পাশে নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের মাদরাসা, মসজিদ, গোরস্থানসহ প্রায় দেড় কিলোমিটার পাকা সড়ক ভেঙে চুরে প্রমত্তা পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে।

এই ভাঙনকবলিত হাজার হাজার নরনারী এখন সরকারি রাস্তার পাশে কোনো রকম মাথা গুজে দিনাতিপাত করছে। এমনকি ফরিদপুর অঞ্চলের রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুরের পদ্মা-মেঘনা, আঁড়িয়াল খাঁ বেষ্টিত তথা নদী তীরবর্তী এলাকার রেকর্ড সংখক নদী মানুষ পরের জায়গায় চুক্তিতে বসাবাস করে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছে।

বৃহত্তর ফরিদপুরের তথা ফরিদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, মাদারীপুর জেলায় ভয়াবহ নদী ভাঙনে প্রায় তিন লাখ পরিবার গৃহহীন হয়ে এখনও চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ তথ্য বেসরকারিভাবে পাওয়া গেছে। নদী ভাঙনকবলিত মানুষের দিক তাকালে মনে হয় এরা যেন জন্মলগ্ন থেকেই অভিশপ্ত। এদের দুঃখ কষ্ট দেখার যেন কেউ নাই।

বৃহত্তর ফরিদপুরে ৪টি জেলার কমপক্ষে ৭ থেকে ৮টি উপজেলার তথা ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন, সদরপুর, আলফাডাঙ্গা মধুখালী, রাজবাড়ি সদর, মাদারীপুর শিবচরের কাঁঠালবাড়িয়ারঘাট, সন্মাষীর চর এলাকা, আঁড়িয়াল খাঁ এলাকা, গাবতলী, শরীয়তপুর ডামুইড্যা, ঘোষাইরহাট এলাকায় সরেজমিন প্রতিবেদনকালে ঐ এলাকার মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায় উল্লেখিত এলাকায় কারো কারো বাড়ি ১০ বার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। ৪টি উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে বহু বাড়িঘর, স্কুল, মাদরাসা, মন্দিরসহ হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি। ফরিদপুর অঞ্চলের পদ্মা আঁড়িয়াল খা, মধুমতি, নদীর ভাঙনে গত ২৪ বছরে প্রায় তিন লাখ পরিবার গৃহহীন হয়েছে বলে জানা যায়। ঐ সকল পরিবার যে যেখানে পারছেন তাদের সুবিধা মতো জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন।

নদী ভাঙনে যে সব উপজেলায় বেশি ক্ষতি হয়েছে তার মধ্যে ফরিদপুর সদরে গত ২০০০ সালের এক জরিপে উঠে আসে ফরিদপুর সদর উপজেলা, সদরপুর, চরভদ্রাসন এই তিন উপজেলায় নদী ভাঙনে ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০০ গত ২৪ বছরে তা বেড় কয়েকগুন হয়েছে। ২০০০ সালের দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রয়াতমন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের দফতরের হিসেব মতে ঐ সময় ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখ। ২০০০ হাজার সাল পেড়িয়ে ২০২৪ সালে এসে নদী ভাঙনে সর্বহারা মানুষের সাথে যোগ হয়েছে কমপক্ষে আরো লক্ষাধিক মানুষ। পূর্বের হিসেব যোগ করলে এই ২৪ বছরে ফরিদপুর অঞ্চলে নদী ভাঙ্গা মানুষের সংখ্যা বেড়ে এখন দাঁড়িয়ে প্রায় ৪ লাখ। যদিও সরকারিভাবে হিসাবে এর সংখ্যা অনেক কম। কিন্ত উল্লেখিত, জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন এনজিওদের তথ্য মতে নদী ভাঙনের এসব মানুষের তথ্য বেরিয়ে আসে।

এরমধ্যে ফরিদপুর সদর থানার ডিক্রিচর ইউনিয়নের ১৪ থেকে ১৫টি গ্রাম, নর্থচানেল ইউনিয়নের ৮/৯টি গ্রাম সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে পদ্মায়। চরভদ্রাসন উপজেলার চরহরিরামপুর ও গাজীরটেক ইউনিয়নের অব্যাহত নদী ভাঙনে ৪টি ইউনিয়নের মাধ্যে একটি গ্রামের ৪ থেকে ৫টি বাড়িসহ সামান্য কিছু অংশ আছে। এর মধ্যে চরঝাউকান্দা ইউনিয়নের ৯৮ ভাগ এবং চরসালেপুর ইউনিয়নের ৮৫ ভাগ পদ্মা বিলীন হয়ে গেছে। এতে নিঃস্ব হয়েছে কয়েক হাজার পরিবার।

সদরপুর উপজেলাটি চরভদ্রাসন উপজেলার পার্শ্ববর্তী উপজেলা এই উপজেলাটিও তার মানচিত্র থেকে বিগত ২৪ বছরের অব্যাহত নদী ভাঙনে হারিয়েছে ঐতিহ্যবাহী পিয়াজখালীর বৃহত্তর বাজার, ট্রলার ঘাট, নৌঘাট, লঞ্চঘাট। এক সময় এই বাজারটি বরিশাল, চাঁদপুর, ভোলা, চট্রগ্রাম, থেকে এসে এখান বড় কার্গো, জাহাজ, দোতালা লঞ্চ, স্টিমার এগুলো বাণিজ্যিক পণ্য নিয়ে লোঙ্গন করত। এই সদরপুরেই অবস্থিত বিশ্ব অলি খাজাবার আটরসি দরবার শরীফ, কামেল পীড় চন্দ্রপাড়ার পীড় সাহেব হুজুরের খানকা ও দরবার শরীফ। নদীভাঙনে এই উপজেলাটি হারিয়েছে লাখ লাখ একর ফসলের জমি ও রাস্তা ঘাট।

ফরিদপুর ভাঙ্গা উপজেলাটি হলো ফরিদপুর জেলার দক্ষিণ সীমান্ত এলাকা। এই উপজেলার চারপাশ ঘিরে আছে প্রমত্তা আড়িয়াল খাঁ এবং কুমার নদী। তবে পূর্ব পাশটি মাদারীপুর পুর শিবচর এলাকার সাথে লাগে না এবং আঁড়িয়াল খা নদীর পাড়ে। পশ্চিম পাশটি ঢাকা জেলার মুন্সিগঞ্জের বিপরীত পাশ এবং পদ্মা নদীর তীরবর্তী ও এলাকা।

ইতোপূর্বে আড়িয়াল খাঁ নদীর তীব্র ভাঙনে নীলুখী ইউনিয়নে ভাঙনের শিকার হয়ে শতশত বাড়িঘর ফসলি জমি হাজার ফলদ ও গাছপালা বিলীন হয়ে গেছে নদীতে। অব্যাহত ভাঙনে ভাঙ্গা উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে কাওয়ালী বেড়া বৃহত্তর ও ঐতিহ্যবাহী লঞ্চঘাটিও। যদিও এখন ও শুকনো মৌসুম চলছে। নদীতে এখন পানি খুবই কম। তারপরও বিশাল বিশাল মাটির চাপ নিয়ে আঁচড়ে পড়ছে। আবার পানি বাড়ার সাথে সাথেই শুরু হয় তীব্র ভাঙন।

অপরদিকে, ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলাটি মাগুড়া ও নড়াইল জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা। এই উপজেলাটি মধুমতী নদীর তীরবর্তী এলাকা। মধুমতীর তীব্র ভাঙনে বিগত ২৪ বছরে উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়েছে চারটি ইউনিয়নের কমপক্ষে ৫ থেকে ৬টি গ্রাম। ঐ উপজেলার প্রায় ৫ তেকে ৬ শতাধিক মানুষ তাদের ভিটে বাড়ি জমি জিড়েত নদীগর্ভে হারিয়েছে। উপজেলার, গোপালপুর, কাতলাসুর, বুড়াইচ ইউপির খোলাবাড়িয়া, পরানপাড়া, টগরবন্দ ইউনিনিয়নের টিটা, গ্রামটি সম্পূর্ণই নদীতে বিলীন হয়েছে। অপরদিকে, বুড়াইচ ইউনিয়নের হেলেঞ্চা, টগরবন্দ ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর, ঘি-দহ নদীগ্রাম, দক্ষিণ ফুলবাড়িয়াসহ ১০ থেকে ১২টি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার পরিবার হারিয়েছে তাদের মাথা গোজার ঠাঁই।

রাজবাড়ী জেলা বৃহত্তর ফরিদপুরের রাজবাড়ী জেলার মধ্যে রাজবাড়ী সদর উপজেলা এবং গোয়ালন্দ উপজেলাটি পদ্মানদী সংলগ্ন তথা দৌলতদিয়া ফেরিঘাট। পদ্মাতীরের নদীভাঙনে দীর্ঘ ২৪ বছরে যন্ত্রায় থাকলেও পদ্মা কাউকেই ছাড় দিচ্ছে না। নদীর একুল ভাঙে ওকুল গড়ে এই চলছে খেলা। এলাকার হাজার হাজার ভুস্বামীর ও জমি জিরেত রাক্ষসী পদ্মা ঘ্রাস করছে। পদ্মার চড়েও এখন তাদের ঠাঁই নাই। নদী ভাঙনকবলিত এলাকার মানুষ তাদের আত্মীয় স্বজনহারাদের জমিতে, কেউ রাস্তার পাশে, কেউ সরকারি জায়গা, কেউ বস্তিঘরে, কেউবা সরকারের আশ্রয়ণে।

রাজবাড়ী সদর থানার চরধুঞ্চুী, দিলিসপুর, বড়চর, বেনীনগর, মৌকূড়ী, আমবাড়িয়া, মালিকান্দার এলাকার নদীভাঙনে এবং বড় বড় চাপ নিয়ে সবুজের ধান ক্ষেত নদীতে দৃশ্য মনে করে বহু মানুষ এখনও কাঁদে। এই চিত্র গোয়ালন্দের ফেরিঘাট এখনও দৃশ্যমান। ঢাকা মানিকগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চল থেকে লঞ্চ অথবা ফেরিতে আসলে এই চিত্র এখনও চোখে পড়ে। এখানে শতশত নদী ভাঙনের শিকার বহু মানুষ এখন গ্রামগঞ্জে তাদের আত্মীয়-স্বজন কেউ সরকারি জায়গায় বাড়িঘর তুলে কোনো রকম বেঁচে আছেন।

অপরদিকে, মাদারীপুর উপজেলার সদর থানার কুমার নদীতে তেমন কোনো ভাঙন লক্ষ্য করা না গেলেও শিবচর উপজেলার দওপাড়া ও কাওরাকান্দি গ্রাম দুটিতে ব্যাপক নদী ভাঙন এখনও অব্যাহত আছে। ঐ দুটি গ্রাম শিবচর উপজেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে প্রায় ৬ থেকে ৭শ’ পরিবার তাদের ভিটে বাড়ি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলছেন প্রমায়। নদী ভাঙনের কবলে পড়ে বৃহত্তর মাদবরচড় হাট, গাবতলা হাট, জমিদার বাড়ি, মাতবরচড় বাজারসহ বিশাল দুটি বাজার এখন পদ্মার বুকে। এখনও ভাঙন কম বেশি অব্যাহত আছে।

এছাড়াও শরীয়তপুর জেলায় বিগত ৩০ বছর যাবৎ একাটানা ভাঙনে ৪০ থেকে ৫০ গ্রাম সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। গৃহহীন হয়েছে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক পরিবার। প্রমত্তা মেঘনায় বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার একর আবাদি ও পতিত জমি। মেঘনার প্রবল স্রোতে মেঘনা গর্ভে চলে গেছে ঘরবাড়ি ও গাছপালা। মেঘনা গিলেছে বেশ কয়েকটি স্কুল, মাদরাসা, মন্দির, খেলারমাঠ ও হাটবাজার। জীবনযাপনের জন্য গত ২০০০ সালেই কয়েক হাজার মানুষ ঢাকা শহরে পাড়ি জমিয়ে এখন সেখানেই বসবাস করছেন। কথিত আছে ১৯৭০ সাল থেকে ২০০৩ সালের ৩০ পর্যন্ত মেঘনা ও পদ্মা তীরবর্তী এলাকার প্রায় ৬০টি গ্রাম বিলীন হয়ে তৎকালীন সময়ের হিসেবে ৮ হাজার বসতবাড়ি নদীর বুকে বিলীন হয়ে গেছে।

এর মধ্যে জাজিরা উপজেলার ১৩ ইউনিয়নের মধ্যে ৫টি ইউনিয়ন, নড়িয়া উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪টি ইউনিয়নের বিস্তৃত এলাকা নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এতে ১৫ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

উল্লেখ্য, উল্লেখিত জেলা ও উপজেলা প্রশাসন চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের সাথে আলাপ করলে কেউ কি পরিমাণ মানুষ গত ২৪ বছরে নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার দিতে পারেননি।