চট্টগ্রাম বন্দরে হঠাৎ শুরু হয়েছে ‘গো স্লো’। তাতে জেনারেল কার্গো বার্থের (জিসিবি) ছয়টি জেটিতে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। কাজের গতি কমে যাওয়ায় বন্দরে জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে যাচ্ছে। আমদানি রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাবে দেখা দিয়েছে মন্দার আশঙ্কা।
আমদানি পণ্য খালাসে দেরি হওয়ায় ভোগ্যপণ্যের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে শিল্পের কাঁচামাল যথা সময়ে কারখানায় পৌঁছাতে না পারায় শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আবার রফতানিপণ্য যথাসময়ে জাহাজীকরণ না হওয়ায় রফতানিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে। তাতে বিদেশে চট্টগ্রাম বন্দর তথা বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে। অলস বসে থাকায় জাহাজগুলোকে দিনে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার ডলারের লোকশান গুণতে হচ্ছে।
বার্থ অপারেটর এবং ভ্যাসেল অপারেটরদের মধ্যে পারিশ্রমিক বাড়ানোর বিরোধের জের ধরে চলছে এই ‘ধীরে চলো’ নীতি। এ ধরনের কর্মসূচির পেছনে দেশবিরোধী চক্রান্তের আভাস পাচ্ছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। তারা বলছেন, পতিত স্বৈরাচারি সরকারের সীমাহীন লুটপাট আর ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার দেশের অর্থনীতিতে গতি ফেরাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বন্দরের সক্ষমতা অতীতের যে কোন সময়ে তুলনায় বেড়েছে। বন্দরে কমেছে জাহাজের গড় অবস্থানকাল।
গত বছর নানা সঙ্কটের মধ্যেও দেশের এই প্রধান সমুদ্র বন্দরে কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে রের্কড অতিক্রম করেছে। বন্দরকে পুরোদমে সচল রাখতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে পবিত্র মাহে রমজানকে সামনে রেখে ভোগ্যপণ্য আমদানি স্বাভাবিক রাখতে বন্দরের কার্যক্রম নির্বিঘœ রাখার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঠিক এই সময়ে এই ধরনের কর্মসূচি দেশের সার্বিক আমদানি-রফতানি ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে স্থবির করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র কী না তা খতিয়ে দেখতে হবে বলেও অভিমত দেন সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রাম বন্দরের জেনারেল কার্গো বার্থের ৬টি জেটিতে কন্টেইনার জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হয়। ছয়টি বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠান এসব জেটিতে বার্থিং নেয়া জাহাজের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করে। প্রতিটি বার্থে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে দুই ভাগে কাজ হয়ে থাকে। কন্টেইনার হুক পয়েন্ট থেকে জাহাজে ওঠানো-নামানোর (অনবোট হ্যান্ডলিং) কাজ করা হয় শিপিং এজেন্টদের পক্ষ থেকে। অপরদিকে হুক পয়েন্ট থেকে ইয়ার্ড পর্যন্ত কাজ করা হয় বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষে।
অনবোট হ্যান্ডলিংয়ের পাশাপাশি বার্থ অপারেটরের কর্মচারীরা কার্গো শিপমেন্ট, ইমপোর্ট বা এক্সপোর্ট পারশিমন, ডিপো থেকে কন্টেইনার কল, ভারী পণ্য বোঝাই কন্টেইনার আগে জাহাজীকরণসহ বেশ কিছু বাড়তি কাজও করে দেয়। দীর্ঘদিন ধরে এই নিয়মে অনবোট কন্টেইনার হ্যান্ডলিং চলে আসছে। বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানকে অনবোট হ্যান্ডলিংয়ের জন্য মাশুল পরিশোধ করে শিপিং এজেন্ট বা ভ্যাসেল অপারেটর। অপরদিকে হুক পয়েন্ট থেকে ইয়ার্ডে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের মাশুল পরিশোধ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। দুইটি মাশুলই নির্ধারিত।
বার্থ অপারেটরদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বিগত ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের সময় যে দর নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে সেই দরেই তাদেরকে এখনো কাজ করতে হচ্ছে। গত ১৮ বছরে বহুমুখী খরচ বেড়েছে, কিন্তু অনবোট হ্যান্ডলিংয়ে বার্থ অপারেটরদের মাশুল বাড়েনি। এতে করে প্রতিটি বার্থ অপারেটর প্রতিষ্ঠানই আর্থিকভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়ছে বলেও দাবি করেন তারা। বিষয়টি নিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ বৈঠকও করে। কিন্তু নানাভাবে চেষ্টা করেও মাশুল বাড়ানো কার্যকর হয়নি বলে জানিয়েছেন বার্থ অপারেটর্স, শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর্স এন্ড টার্মিনাল ওনার্স এসোসিয়েশন।
এসোসিয়েশনের নেতারা জানান, তারা বহুদিন ধরে মাশুল বাড়ানোর জন্য অনুরোধ জানিয়ে আসলেও আজ নয় কাল করে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। তারা কন্টেইনার প্রতি ৫ ডলার বাড়ানোর দাবি করেন। মূলত এই দাবিতেই চলতি মাসের শুরু থেকে কোন রকম ঘোষণা ছাড়াই কাজে ধীরগতি শুরু করেন তারা।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ ইনকিলাবকে বলেন, ধীরে চলো নীতির কারণে দেশের সার্বিক আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাতে বিদেশে চট্টগ্রাম বন্দর তথা দেশের সুনাম ক্ষুণœ হচ্ছে। যথা সময়ে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং না হওয়ায় আমদানি রফতানি ব্যয় বাড়ছে তাতে ভোক্তাদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বিষয়টি নিয়ে গতকালও চট্টগ্রাম বন্দরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা কাজে গতি আনতে বলেছি। কারো কোন দাবি থাকলে সেটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু জিম্মি করে দাবি আদায়ের কোন সুযোগ নেই। আমরা আশা করি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বিষয়টির সমাধান বের করবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে একটি কন্টেইনারের অনবোট হ্যান্ডলিং চার্জ ৫৬০ টাকার মতো। অথচ তারা এখন দাবি করছে ৫ ডলার অর্থাৎ ৬২৫ টাকা বাড়াতে। ৫৬০ টাকার কাজে ৬২৫ ডলার বাড়ানোর দাবিতে তারা গো সেøা শুরু করেছেন।
এ ধরনের কর্মসূচি বন্দরের সার্বিক উৎপাদনশীলতায় মারাত্মক রকমের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে উল্লেখ করে ভ্যাসেল অপারেটরেরা বলেছেন, এতে বন্দরে জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে যাচ্ছে। তবে বন্দরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে তারা সবার সাথে যোগাযোগ করেছেন। দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলেও আশাবাদি তারা।
আপনার মতামত লিখুন :