সালাহউদ্দিন বাবর
পতিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর পুনরুত্থান ও পুনর্বাসন নিয়ে কারো কারো উৎসাহ-উদ্দীপনা মাত্রাতিরিক্ত বলে সাম্প্রতিককালে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। জনধিকৃত ও বিতাড়িত ওই গোষ্ঠীকে সহায়তার নানা অপকৌশল হচ্ছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। সোস্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন ফোরামে এ নিয়ে ঘোর আপত্তি ও ক্ষোভ লক্ষ করা গেছে।
এক তরুণ খ্যাতিমান বক্তা, আইনজীবী ও রাজনীতিক অতি সম্প্রতি সোস্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার হয়ে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে অভিযোগ করেন, ১৯৮১ সালে শহীদ জিয়াউর রহমান আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করে তাকে প্রায়শ্চিত করতে হয়েছে তার জীবন দিয়ে। এরপর এরশাদ আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত করেন, তার দল জাতীয় পার্টি গৃহপালিত দলে পরিণত হয়, পরে পাঁচ খণ্ড হয়ে জাপা এখন বিলীয়মান। এরপর ১৯৯৬-এ জামায়াত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসতে সাহায্য করে। পরিণতিতে তাদের দলের শীর্ষ নেতাদের বিনা অপরাধে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেন সরকার পুনরায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা দিয়ে জাতীয় বিশ্বাসঘাতকের তকমা পেয়েছে। এর কুশীলবরা দেশছাড়া হয়েছেন।
তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, কেউ কেউ পতিত স্বৈরাচারকে আবার ফিরিয়ে আনতে নানা কলাকৌশল করছে। এমন অধোগতি আসলে সংশ্লিষ্টদের গোপন আকুতি। এমন বিকৃতির অর্থ হলো হাজারো শহীদের রক্ত মাড়িয়ে স্বার্থসিদ্ধির পথে হাঁটা। বক্তা আরো বলেন, এমন পথযাত্রাকে যেকোনো মূল্যে সাগরে ভাসানো হবে। দেশের মানুষ পতিতদের অপছায়া আর সহ্য করবে না। অন্য এক ইতিহাসবেত্তা, তুখোড় বক্তা ও তরুণ উদীয়মান রাজনীতিক সোস্যাল মিডিয়ায় উপস্থিত হয়ে তীব্র ক্ষোভের সাথে বলেছেন, অলিগলি বা কোনো ছিদ্রপথ দিয়ে পতিত স্বৈরাচারের অনুপ্রবেশের সব অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়া হবে।
এমন সোহাগ ও স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করা হবে। বোদ্ধা এমন সব রাজনীতিকের ভাব-ভাষা ও দেহভঙ্গিমার মাঝে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে ১৮ কোটি মানুষের অনুভূতি ও অভিব্যক্তি। এই চেতনার প্রতিফলন দেখা গেছে দেশের বিভিন্ন সীমান্তে পর্যন্ত। কাস্তে হাতে, লাঠি নিয়ে সেনাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন হাজারো তরুণ-যুবক-প্রবীণ ও নারী। এই যুব-জ্যেষ্ঠরা জাতির নিরাপত্তা দিতে জীবন বাজি রাখছেন। এরাই এই ‘মার্শাল ন্যাশনের’ প্রতীক, এ এক অপূর্ব রূপান্তর, যা দেখা গেছে একাত্তরে। যা সুপ্ত ছিল। এখন সেই চেতনা লালন-পালন ও উদীপ্ত করতে এক ছাতার নিচে জড়ো হচ্ছে গোটা জাতি। এক সুরে এক লয়ে বাঁধা তাদের ভাব-ভাবনা। এখনো যারা পতিতদের নিয়ে স্বপ্নে বিভোর, তাদের সেই স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করবে এরাই।
আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল যারা, তারা এ জনপদের নতুন ধ্যানধারণার সাথে সহাবস্থান করছেন না বলে সবার মনে এমন সন্দেহ তৈরি হয়েছে। জাতি বিস্ময়ে হতবাক, প্রবীণদের মধ্যে এখন তারুণ্যের ঝলক দেখে। আবার কিছু নবীনের মধ্যে পতিতদের জন্য সহানুভূতিও সবার মনে ক্রোধের উদ্রেক করছে। তরুণ মন নতুন দিনকে স্বাগত জানাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছে। এখন সময় এসেছে স্থবিরতা বা গতিময়তার কোনো একটিকে বেছে নেয়ার। স্থবিরতা হচ্ছে, অতীতে বিলীন হয়ে যাওয়া, আর গতির ভেতর থাকে অপার সম্ভাবনা ও সম্মুখে চলার প্রেরণা।
পতিতের প্রত্যাবর্তনের পরিণতি কেমন হতে পারে সেটি কল্পনাতীত, শুধু গত ১৬ বছর জাতির ও বিভিন্ন জাতীয় রাজনৈতিক দলের ওপর অবিরাম যে অত্যাচার-অবিচার, গুম-খুন, জেল-জুলুম হয়েছে। সে স্মৃতি কারো মনমানসে জাগলে তাকে ‘ট্রমায়’ পৌঁছাতে হচ্ছে। লীগ নেতা ওবায়দুল কাদের তাদের পতনের আগে একবার বলেছিলেন, তার দলের পতন হলে পাঁচ লাখ মানুষের জীবনাবসান ঘটবে। বাস্তবতা হচ্ছেÑ লীগের পতনের পর পাঁচ ব্যক্তিরও জীবন দিতে হয়নি। যারা এখন জেলে গেছেন, তারা তাদের কর্মদোষে জেলহাজতে। তারা সবাই গুম, খুন, লুটপাট, চুরি-জোচ্চুরি ও জাতীয় সম্পদ পাচার-আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট কারণে এখন জেলজীবনে। লীগ আমলে কোনো আইন-কানুন বিচার ছিল না। এখন তারা অতীত পাপাচারের প্রায়শ্চিত্ত করছেন। লীগ এখন সুচ নয়, ছদ্মবেশে ফাল হয়ে তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।
সম্প্রতি এক জাতীয় দৈনিকের খবরে প্রকাশ দেশ থেকে আওয়ামী লীগ নেতারা যে বিপুল অর্থ নিয়ে দেশ ছেড়েছেন; তারা অরাজকতা সৃষ্টিতে পাচার করা অর্থের একটি অংশ রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে পাঠাচ্ছেন। এ অর্থে বাংলাদেশে অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চলছে। অতি সম্প্রতি অন্য এক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, দেশে রেল ধর্মঘটের পেছনে ছিল ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা ও তার অন্যান্য সহযোগী। এখন গোটা দেশে অযৌক্তিক যত দাবি নিয়ে যে মিছিল মিটিং বিক্ষোভ-সমাবেশ পথরোধ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে লীগ নেতাদের যত ছলাকলা। দেশকে অচল-অকার্যকর করা। অথচ এসব আওয়ামী কুচক্রীর দেশে ফেরানোর অপচেষ্টা করছে কিছু মানুষ।
এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের মানুষ এখন আর বসে থাকতে রাজি নন। তারা এসবের প্রতিউত্তর দিতে তৈরি। আত্ম আবিষ্কারে প্রত্যয়ী, এ মাটির মানুষের মন বর্ষায় যেমন গলে ক্ষয়ে যায়; চৈত্রে আবার ঠিক পাথর হয়ে ওঠে। ’২৪-এর শেষ অধ্যায়ে ওই চৈত্রের চেতনা নিয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন, যা ভাবা হয়েছিল অজেয়, তাকে জয় করেছেন। একটি বিন্দু থেকে বৃত্তের সৃষ্টি হয়। তেমনি ছাত্ররা প্রথমে বিন্দু হয়ে পথে নেমেছিল, পরে সেটি সিন্ধুতে পরিণত হয়। সময়ের এ রূপান্তর ধরতে বুঝতে হবে। সেটি না হলে পিছলে পড়তে হবে। দেশের মানুষ অনেক শুনেছেন শিশুকে ঘুম পাড়ানো যত ছড়া। এমন সব ছড়া শুনে দীর্ষ ১৫-১৬ বছর জনতা শিশু-কিশোর প্রায় ঘুমিয়েছিল। আবার সেই জনতা জীয়নকাঠির স্পর্শে জেগে উঠেছে আগস্ট বিপ্লবের পর।
পটপরিবর্তনের সুবিধা নিতে কেউ কি বাদ পড়েছে! এমনকি যারা পটপরিবর্তনের সপক্ষে থাকার কথা অস্বীকার করেছেন, তারা এ পটপরিবর্তনের সুবিধা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব করেছেন। পটপরিবর্তনের পরে দাবি করা হয়, তারা নাকি আগস্ট বিপ্লবের প্রকৃত স্থপতি। অথচ অগ্নিঝরা সেই দিনগুলোতে তাদের কারো ছায়া পর্যন্ত রাজপথে ছিল না।
যা হোক, ইতিহাস কারো মুখ দেখে রচনা হয় না। ঘটনাপ্রবাহের ভেতর থেকে কেবল খাঁটি বাক্যগুলো চয়ন করা হয়। ’২৪-এর আগস্ট বিপ্লবের মূল কারিগর হিসেবে যারা দাবি করেছেন, তারা কিন্তু একই সাথে বর্তমান সংবিধানের সুরক্ষা চান। আগস্ট বিপ্লব সংবিধানে বিধিবিধান অনুসরণ করে সংঘটিত হয়নি; বরং সংবিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হয়েছে। এক দিকে তারা সংবিধান সুরক্ষা চান আবার অন্য দিকে সংবিধান অমান্য করে বিপ্লব সংঘটিত করেছেন। কথার এমন বৈপরীত্ব সুস্থতার লক্ষণ নয়।
পতিত সরকার একান্ত ব্যক্তি ও দলের জন্য যে সংবিধান রচনা করেছে, সেটি কখনো সবার সংবিধান হতে পারে না। সেই সংবিধানে তাদের নিজেদের এমন সুরক্ষা দেয়ার বিধান আছে। তাদের যদি কেউ পতন ঘটানোর চেষ্টা করে তবে তাদের সর্বোচ্চ দণ্ড দেয়ার বিধান আছে। সে ক্ষেত্রে বিপ্লব সংঘটিত করে স্বৈরাচারের পতন ঘটানো দাবিদার যারা, তারা কি রেহাই পাবে। তবে ভিন্ন কোনো বন্দোবস্ত হয়ে থাকলে অন্য কথা। কিন্তু এমন বন্দোবস্ত কি জাতির স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক নয়? সেটি শুধু বড় প্রশ্নই নয়; একই সাথে এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না পতিতদের সাথে আশ্রয়-প্রশ্রয়দানকারীদের ভাগ্য না জড়িয়ে।
আরো কথা আছে, যাদের আদর সোহাগ করে ঘরে তুলতে চাওয়া হচ্ছে, তাদের বানরের পিঠা ভাগের কাহিনীটা মনে রাখতে হবে। দেখা যাবে শেষে আম-ছালা দুটোই হাতছাড়া হয়েছে। পতিতের টাকার অভাব নেই, পক্ষান্তরে কারো কারো অর্থের ঘাটতি আছে। সেটি তো ইতোমধ্যে দিবালোকের মতো স্বচ্ছ হয়েছে।
’২৪ জানুয়ারির তথাকথিত নির্বাচনের আগে পতিতদের বিপক্ষে অনেকে কোমরে গামছা বেঁধে রাজপথে নেমেছিল। হঠাৎ আবার রাত পোহাতে দেখা গেল কেউ অভাবী ভিক্ষুক নয়, তবে স্বভাবে ভিক্ষুক। মাত্র কিছু টাকা পেয়ে মধ্যরাতে পল্টি দিলেন। কাউকে কাউকে হয়তো লাখ টাকায় কেনা, কোটি টাকায় কেনা যাবে। বাংলাদেশের নিঃস্ব মানুষের রক্ত চুষে আদানি-মাদানিদের বপু ফুলছে। অথচ এই আদানি-মাদানির কারো কারো প্রিয়ভাজন হয়ে উঠছে।
অবাক করলে তুমি, নতুন প্রজন্ম জন্মেই দেখছে অদ্ভুত এক বুভুক্ষ জন্মভূমি। আসলে ক্ষুধা মেটাতে কয় ‘সানকি’ ভাতের প্রয়োজন হয়? এখন বারবার মনে পড়ছে টলস্টয়ের সেই গল্পের কথা। একজন মানুষের কতটুকু জমির দরকার? ছয় হাত বাই দুই হাত। জমিদারদের কেউ মনে রাখে না। জমিজিরাত যারা অকাতরে বিলায় তারাই স্মরণীয় হন। হাজী মুহসীনরা যুগ যুগ বেঁচে থাকেন।
আপনার মতামত লিখুন :