ভাষাগত বৈচিত্র্যের দেশ ভারত। কিন্তু সেই বৈচিত্র্যের মাঝেও ক্রমে যেন একক ভাষার আগ্রাসন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সম্প্রতি মহারাষ্ট্র সরকার ঘোষণা দিয়েছে (২০২৫-২৬) শিক্ষাবর্ষ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত হিন্দি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজ্যটির রাজনৈতিক অঙ্গন।
এ নিয়ে অনেকেই বলছেন, পাকিস্তান যেমন একসময় বাঙালিদের ওপর উর্দু চাপিয়ে দিয়েছিল, ঠিক তেমনি বিজেপি এখন মারাঠিদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে হিন্দি।
এই পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলনের সময়কার প্রেক্ষাপটের মিল রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলে, পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) সরকার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে শুধু উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চায়।
অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণ বাংলা ভাষায় কথা বলত। এই চাপের বিরুদ্ধে বাঙালিরা তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রাণ দিয়ে বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষা করে।
আজকের মহারাষ্ট্রের ঘটনাপ্রবাহ অনেক বিশ্লেষকের কাছে ভাষার নামে সেই পুরোনো আধিপত্যেরই আধুনিক রূপ বলে মনে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, মহারাষ্ট্রে প্রথম ভাষা মারাঠি, দ্বিতীয় ভাষা ইংরেজি। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এখন তৃতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে ত্রিভাষা শিক্ষা পদ্ধতির কথা বলা হলেও, রাজ্যগুলো সাধারণত তৃতীয় ভাষা নির্ধারণে স্বাধীন। কিন্তু বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্র সরকার সেই নিয়ম লঙ্ঘন করেই হিন্দিকে চাপিয়ে দিচ্ছে।
এই সিদ্ধান্ত ঘিরে সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া এসেছে মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনা (এমএনএস) নেতা রাজ ঠাকরের কাছ থেকে। তিনি বলেন, আমরা হিন্দু, কিন্তু হিন্দিভাষী নই। আমরা মারাঠি। এই সিদ্ধান্ত মারাঠিদের ভাষা ও পরিচয়ের ওপর সরাসরি আঘাত। রাজ ঠাকরের মতে, জোর করে হিন্দি চাপানোর এই সিদ্ধান্ত মারাঠি ও অমারাঠিদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করবে।
শুধু রাজ ঠাকরেই নন, কংগ্রেসসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলোও এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। তারা মনে করে, হিন্দিকে বাধ্যতামূলক করে শিক্ষার্থীদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করা হচ্ছে এবং আঞ্চলিক সংস্কৃতির ওপর কেন্দ্রীয় আগ্রাসন ঘটানো হচ্ছে। বিজেপির ভেতরেও এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। শিবসেনা থেকে বেরিয়ে আসা একনাথ শিন্ডে এখন উপমুখ্যমন্ত্রী হলেও, তিনিও রাজ ঠাকরের অবস্থানের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলছে- ভাষা যদি জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা কেবল শিক্ষাগত বা প্রশাসনিক নয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিদ্রোহের জন্ম দেয়।
একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদরা যেমন উর্দুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন, তেমনিভাবে মহারাষ্ট্রেও হিন্দির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা কেবল ভাষার নয়- অস্মিতা, স্বাতন্ত্র্য ও আত্মপরিচয়ের লড়াই।
ভারতের মতো বহু ভাষাভাষীর দেশে একক ভাষার আধিপত্য আরোপ কোনোভাবে টেকসই নয়। ভাষা কখনোই জোর করে চাপিয়ে দেওয়া যায় না- বাংলাদেশের ইতিহাস তার জ্বলন্ত উদাহরণ। এবার দেখা যাক, মহারাষ্ট্রের মারাঠিরা কীভাবে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার রক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে।
সূত্র : হিন্দুস্তান টাইমস
আপনার মতামত লিখুন :