একাধিক অনিয়মের অভিযোগের পরও আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ড. তৌহিদ বহাল তবিয়তে


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : মে ৪, ২০২৫, ৯:২৫ পূর্বাহ্ণ /
একাধিক অনিয়মের অভিযোগের পরও আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ড. তৌহিদ বহাল তবিয়তে
  • ড. তৌহিদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় কেউ মুখ খুলেনি। ৫ আগস্টের পর থেকে বিভাগে তাকে নিয়ে কানাঘুষা চলছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে ড. তৌহিদের অবস্থান ছিল স্পষ্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান ড. মো: তৌহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনৈতিক কর্মকাণ্ড, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান, শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী ছাত্রলীগকর্মীকে পরীক্ষায় অংশ নেয়ার সুপারিশ, বিভাগের বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগকে পুনর্বাসন, পরীক্ষার খাতায় শিক্ষার্থীকে অতিরিক্ত নম্বর প্রদান, থিসিস জালিয়াতিসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ উঠেছে। এত অভিযোগের পরেও তার বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি, বরং তাকে বিভাগীয় বিভিন্ন পদে বসিয়ে পুরস্কৃত করার অভিযোগ উঠেছে।

ড. তৌহিদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিমের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় কেউ মুখ না খুললেও ৫ আগস্টের পর থেকে বিভাগে তাকে নিয়ে কানাঘুষা চলছে। কেউ সরাসরি কিছু না বললেও তার নামে তিন পৃষ্ঠার একটি অভিযোগনামা অনুষদে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এ অভিযোগনামা সম্প্রতি শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগসহ সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে পাওয়া গেছে। অভিযোগগুলোর বিষয়ে বিভাগে খোঁজ নিয়ে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের উপকমিটিতে থাকায় ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে তার প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিপক্ষে তার অবস্থান ছিল স্পষ্ট। সরকার পতনের সাথে সাথে তিনি নিজেকে কৌশলে বাঁচিয়ে নেন। যদিও বিভাগের অন্য দু’জন শিক্ষক রফিক শাহরিয়ার ও মারিয়া হোসাইন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ক্ষমা চেয়ে সব অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজ হতে বিরত রয়েছেন। অন্য দিকে বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী ক্ষমা না চাওয়ায় তিনিও বিভাগের সব কাজ থেকে বিরত রয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী একই স্কলারশিপে একাধিকবার বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাওয়া নিয়মবহির্ভূত হলেও, ড. তৌহিদুল ইসলাম কমনওয়েলথ স্কলারশিপের সুযোগ নিয়ে দুবার বিদেশে যান বলে অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে প্রশাসনে মৌখিক অভিযোগ জমা পড়লেও কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিভাগের শিক্ষকদের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের অভিযোগ নতুন নয়। দীর্ঘ দিন ধরে বিভাগীয় ছাত্র উপদেষ্টা, ডিবেটিং ক্লাবের মডারেটর এবং ক্রীড়া তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করে আসছেন ড. তৌহিদ। সম্প্রতি বিতর্কিতভাবে বিভাগের ডিবেটিং ক্লাবের নতুন কমিটি গঠনের সময়ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ রয়েছে, নিরপেক্ষ এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে শুধু ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে।

জানা যায়, ১৫ই জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারী শিক্ষার্থী সুমন নন্দীকে তিনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য সুপারিশ করেন। তা ছাড়া, ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্তদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুবিধা দিতে তিনি বিভাগের ছাত্র উপদেষ্টার পদ দখল করে আছেন। এমনকি স্যার এ এফ রহমান হলের হাউজ টিউটর হিসেবেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন।

সূত্র আরো জানায়, বিভাগের ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী উম্মে আশামনি হাজারীর সপ্তম সেমিস্টারের পোট্রাক্টেড কনফ্লিক্ট কোর্সের পরীক্ষার উত্তরপত্রে মাত্র দু’টি প্রশ্নের উত্তর থাকা সত্ত্বেও অনৈতিকভাবে তাকে চারটি উত্তরের নম্বর দেন ড. তৌহিদ। এ কারণে উম্মে আশামনির ওই কোর্সের ফলাফল স্থগিতের পর উচ্চতর তদন্তের কথা থাকলেও অদৃশ্য রাজনৈতিক প্রভাবে তা আর এগোয়নি বলে গুঞ্জন রয়েছে।

এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ ঢাবি থেকে অনার্স-মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে দেশের অন্য একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করে এ বিভাগে যোগ দিলেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা ড. তৌহিদ ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে ২০০৮ সালে সিনিয়র পদ লুফে নেন। এরপর ২০১৬ সালে সাইফুদ্দীন আহমদ যখন বিভাগের চেয়ারম্যান হয়ে যাচ্ছেন, তখন তাকে টেক্কা দিতে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ব্র্যাডফোর্ডে পিএইচডি চলাকালে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে ড. তৌহিদ দেশে চলে আসেন। অনেকের ধারণা, পিএইচডি সম্পন্ন না করেই তিনি দেশে ফিরেছিলেন।

জানা যায়, ড. তৌহিদ ২০২৩ সালের জুন মাসে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতির দরখাস্ত জমা দিয়ে দু’দিনের মাথায় তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. সাবের হোসেনের কাছ থেকে সংশোধনের কথা বলে ফিরিয়ে নিয়ে দুই বছর পরও তা জমা দেননি। সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, তার পিএইচডি থিসিস নিয়ে বিতর্ক ও নানা প্রশ্ন থাকায় এমনটা হতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাস্টার্সের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, অতীতে বর্তমান চেয়ারম্যান সাজ্জাদ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির ভিত্তিহীন অভিযোগে ড. তৌহিদুল ইসলামের সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে আন্দোলনের পক্ষে থাকা ড. সাবেরের অব্যাহতির পেছনেও তার ভূমিকা ছিল বলে তারা দাবি করেন।

এ ছাড়াও ড. তৌহিদের থিসিসের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ড. তৌহিদের পিএইচডি থিসিসে কেবল অধ্যাপক ডালেম চন্দ্র বর্মণের স্বাক্ষর ও নাম আছে লোকাল সুপারভাইজর হিসেবে, যা খুবই বিস্ময়ের। বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ধারণা হয়ত এই জন্যই তিনি অধ্যাপক পদে আবেদন জমা দিয়ে ফেরত নিয়ে নিয়েছেন।

সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ডিপার্টমেন্টের ৩০৬ জনের মধ্যে মাত্র ১৫ জন আজ্ঞাবহ শিক্ষার্থী আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। অথচ আমি কোন রাজনৈতিক দলের সাথেই ওইভাবে যুক্ত নই। আমার বিরুদ্ধে যে অনেক বড় একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে সেটা বোঝাই যায়। আমার পদোন্নতির আবেদন পত্রটি ডিসেম্বরে সিন্ডিকেটে এজেন্ডাভুক্ত হলেও আজ পাঁচ মাস হয়ে গেল আলোচনাই হয়নি। আমাকে কোন বেতন-ভাতাও দেয়া হচ্ছে না। বিগত চেয়ারম্যান রফিক শাহরিয়ারও সিঅ্যান্ডডি মিটিং ডাকেননি কারণ ড. তৌহিদ পরবর্তীতে আর আবেদন করেননি। আর আমি যখন চেয়ারম্যান ছিলাম তখন ডক্টর তৌহিদ অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য আবেদন করেছিলেন। পরে সেই আবেদন তিনি তুলে নেন।

এ বিষয়ে বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমদকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি তথ্য জানার জন্য মেসেজ দেয়া হলেও উত্তর আসেনি। এসব বিষয়ে লিখিত অভিযোগ না থাকায় কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী।

সার্বিক বিষয়ে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ বলেন, উক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে এখনো কোনো অভিযোগ আসেনি। সুস্পষ্ট অভিযোগ আসলে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করব। তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যাবস্থা গ্রহণ করবে।