সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় চলছে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা। ১ জুন থেকে শুরু হওয়া এই সময়ে বনজীবী ও পর্যটকদের বনে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও থামেনি চোরা শিকারিদের তৎপরতা। বন বিভাগের নিয়মিত অভিযানে প্রতিনিয়ত উদ্ধার হচ্ছে হরিণ শিকারের নানা ধরনের ফাঁদ। শুধু জুন মাসের প্রথম ২০ দিনেই সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ হরিণ শিকারের দুই হাজারের বেশি ফাঁদ উদ্ধার করেছে। এ সময় নৌকা-ট্রলার, বিষ ও কাঁকড়া ধরার নিষিদ্ধ চারু উদ্ধার ছাড়াও ১২ জনকে আটক করা হয়েছে। এর আগেও গত মে মাসে সুন্দরবনের পূর্বাংশে উদ্ধার হয়েছিল সহস্রাধিক ফাঁদ।
সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ মূলত ‘পূর্ব ও পশ্চিম’—এই দুটি প্রশাসনিক বিভাগে বিভক্ত। খুলনা ও সাতক্ষীরা অংশ নিয়ে পশ্চিম সুন্দরবন। আর বাগেরহাট ও খুলনার সামান্য অংশ নিয়ে পূর্ব সুন্দরবন।
মালা, ছিটকা ও হাঁটা ফাঁদে ঝরে হরিণের প্রাণ:
সুন্দরবনে হরিণ শিকারে বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে রাখে চোরা শিকারিরা। এর মধ্যে মালা ফাঁদ, ছিটকা ফাঁদ ও হাঁটা ফাঁদ—এই তিন ধরনের ফাঁদের ব্যবহার বেশি। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সম্প্রতি উদ্ধার ফাঁদের হিসাবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে ‘মালা ফাঁদ’, যা পাতা হয় চিকন দড়ি বা রশি দিয়ে। গাছের গোড়ার দিকে একটার পর একটা বৃত্ত আকারে মালার মতো এই ফাঁদ পাতা হয়। এতে দৌড়ে যাওয়া হরিণ না বুঝে আটকে পড়ে। রশি ছাড়াও সম্প্রতি জিআই তার বা গুনা দিয়ে তৈরি মালা ফাঁদ বনে পাতা অবস্থায় পাওয়া গেছে।
এরপর বেশি দেখা যায় ‘ছিটকা ফাঁদ’। গাছের ডাল বা কচার সঙ্গে পাতা হয় এই ফাঁদ। টেনে এমনভাবে মাটিতে নুইয়ে ডাল বা কচা দড়ির সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়, যাতে হরিণ পা ফেললে সেটি ডালসহ উঠে ঝুলে যাবে। এ ছাড়া আছে ‘হাঁটা ফাঁদ’। হরিণ শিকারের জন্য গাছ থেকে ঝুলিয়ে রাখা হয় এই ফাঁদ।
এক দিনেই ৬০০টি ফাঁদ উদ্ধার: ১৬ জুন সুন্দরবনের একটি এলাকা থেকেই উদ্ধার হয় হরিণ শিকারের ব্যবহৃত ৬০০টি মালা ফাঁদ। শরণখোলা রেঞ্জের কোকিলমণি টহল ফাঁড়ির বনকর্মীরা গহিন বনের টিয়ারচর এলাকায় ‘প্যারালাল লাইন সার্চিং’-এর সময় পেতে রাখা ওই ফাঁদ দেখতে পান। সেখান থেকে ১৬টি কাঁকড়া ধরার নিষিদ্ধ চারু ছাড়াও খালের পাড়ে মাটিতে পুঁতে রাখা ফাঁদও জব্দ করা হয়। তবে নৌকা বা কাউকে আটক করা যায়নি।
এর তিন দিন আগে চাঁদপাই রেঞ্জের হুলার ভারানী ও সূর্যমুখী খালসংলগ্ন বনাঞ্চলে পায়ে হেঁটে তল্লাশির সময়ে ১৩৫টি মালা ফাঁদ উদ্ধার হয়। ১৯ জুন চান্দেশ্বর ক্যাম্প এলাকার বনাঞ্চলে পেতে রাখা আরও ৩৬০টি হরিণ শিকারের মালা ফাঁদ উদ্ধার করে বন বিভাগ। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি জুন মাসের প্রথম ২০ দিনে তাদের অভিযানে হরিণ শিকারের বিভিন্ন ধরনের ২ হাজার ৬১৫টি ফাঁদ জব্দ করা হয়েছে। এ সময় ২৬টি অভিযানে ফাঁদ ছাড়াও ১৬টি নৌকা ও ট্রলার, ৬ বোতল বিষ, বিষ দিয়ে শিকার করা ১৩০ কেজি মাছ, ১১০টি চারু (কাঁকড়া ধরার ফাঁদ), হরিণ ধরার ফাঁদ তৈরিতে ব্যবহৃত ২ বান্ডিল নাইলন দড়ি এবং ১২ জনকে আটক করা হয়েছে। বন অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ১২টি মামলাও করা হয়েছে এই সময়ে।
এর আগে গত মে মাসে চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ এলাকায় ৩৭টি অভিযান চালিয়ে হরিণ শিকারের ১২৫টি মালা ফাঁদ, ৭৮টি ছিটকা ফাঁদ, ৪টি নৌকা ও ট্রলার, ৩টি হরিণের মাথা, ৪২ কেজি মাংস এবং ২ জনকে আটক করা হয়। এ সময় বন আইনে ১৫টি মামলা করা হয়। প্রতিবার উদ্ধারের পর দড়ি দিয়ে তৈরি ওই ফাঁদগুলো আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে বন বিভাগ।
হাঁটা টহলে শনাক্ত হচ্ছে ফাঁদ: সাধারণত সুন্দরবনের নদী-খালে নৌযানের মাধ্যমে টহল কার্যক্রম চলে বেশি। তবে প্যারালাল লাইন সার্চিং নামের একধরনের টহল শুরু করেছেন বনকর্মীরা। এই পদ্ধতিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে লাইন করে বনের মধ্য দিয়ে হেঁটে যান তাঁরা। এতে ফাঁদ বা বনের মধ্যে পাতা কিছু দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হয়। যদিও দুর্গম সুন্দরবনের সব এলাকায় এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, বাঘ-কুমিরের আক্রমণের ঝুঁকিও আছে।
এটা বেশ কষ্টসাধ্য ও চ্যালেঞ্জিং জানিয়ে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, হেঁটে এই টহল বেশ কার্যকর হচ্ছে। এর মাধ্যমে বনে পেতে রাখা হরিণ শিকারের ফাঁদগুলো দ্রুত শনাক্ত করা যাচ্ছে এবং বহু হরিণ বেঁচে যাচ্ছে। হরিণ রক্ষায় চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ নিয়ে গঠিত সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এই বনাঞ্চলে শিকারে জড়িত ১৫০ জন ব্যক্তির একটি হালনাগাদ তালিকা করেছে। চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) দ্বীপন চন্দ্র দাস বলেন, দুর্গম বনে হেঁটে টহল কার্যক্রমের পাশাপাশি স্মার্ট প্যাট্রলিং ও ড্রোনের মাধ্যমেও নজরদারি করা হচ্ছে। সম্প্রতি ড্রোন ব্যবহার করে একটি অবৈধ নৌকা শনাক্ত ও জব্দ করা হয়েছে।
‘সামাজিক চাহিদা’ বড় বাধা: বনসংলগ্ন গ্রামের বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘বিশেষ অতিথি’ এলে হরিণের মাংস রান্না এখনো চলে। শরণখোলার সোনাতলা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব এক প্রবীণ বলেন, ‘এই এলাকায় রাস্তা করতে আসা ঠিকাদার থেকে শ্রমিক, প্রশাসন থেকে পুলিশ—অধিকাংশের মধ্যেই একবার হলেও হরিণের মাংস খাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। আমরাও তো লোভী! ঘুষ হিসেবেও দেওয়া হয় হরিণের মাংস।’
মোংলার জয়মণি ও দাকোপের ঢাংমারী গ্রামের তিনজন বাসিন্দা বলেন, বাড়িতে নতুন জামাই বা বিশেষ অতিথি এলে অনেকে এখনো হরিণের মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করেন। কড়াকড়ি থাকলেও হরিণের মাংস লাগলে ঠিকই পাওয়া যায়। চাহিদা বন্ধ না হলে সুন্দরবনে হরিণ শিকারও বন্ধ হবে না উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বাগেরহাটের সম্পাদক এস কে হাসিব বলেন, হরিণ শুধু সুন্দরবনের শোভা নয়—বাঘের খাদ্য, বনজ জীববৈচিত্র্যের অংশ। শিকার বন্ধ না হলে বাঘও তার খাবার হারাবে। তাই হরিণ শিকার বন্ধে প্রয়োজন সামাজিক প্রতিরোধ, ভোক্তাদের বর্জন এবং প্রশাসনিক দৃঢ়তা।
ডিএফও মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘শিকারির সঙ্গে সঙ্গে যারা হরিণের মাংস খায়, তাদেরও মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। এদের সামাজিকভাবে বর্জন করা দরকার। ভোক্তা আছে বলেই শিকারিরা চুরি করে সুন্দরবনে ঢোকে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কাদা-মাটির মধ্যে প্রচণ্ড কষ্টকর সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে বনকর্মীরা হেঁটে দুর্গম বনে টহল দিচ্ছেন।’
আপনার মতামত লিখুন :