বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি, অ্যামাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস এবং সাংবাদিক ও সমাজসেবী লরেন সানচেজের রাজকীয় বিয়ে অনুষ্ঠান শনিবার শেষ হয়েছে। ইতালির ভেনিসে বৃস্পতিবার থেকে শুরু হয়ে টানা তিন দিন চলেছে এই জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন, যেখানে প্রেম, বিলাসিতা, প্রযুক্তি ও প্রভাবশালী মুখের মিলনে এক নজিরবিহীন দৃশ্যপট তৈরি হয়।
বিয়ের সূচনা হয় বৃহস্পতিবার সকালে, যখন বেজোস ও সানচেজকে ভেনিসের গ্র্যান্ড ক্যানালের ধারে অবস্থিত আমান হোটেলের ছাদে প্রেমালাপের ছোঁয়ায় দেখা যায়। এরপর তারা তাদের অতিথিদের নিয়ে পানির ট্যাক্সিতে চড়ে ম্যাডোনা ডেল’অরতো ক্লয়েস্টারের দিকে এগিয়ে যান। শহরজুড়ে সে সময় নিরাপত্তা ছিল চূড়ান্ত মাত্রায়। পাপারাজ্জিরাও নৌকায় করে দম্পতির পিছু নেয়, আর পুলিশ টহল দেয় নিষিদ্ধ এলাকায়।
এই তিন দিনব্যাপী আয়োজনকে ঘিরে ভেনিস হয়ে ওঠে তারকাদের মিলনমেলা। অতিথিদের তালিকায় ছিলেন অপরা উইনফ্রে, অরল্যান্ডো ব্লুম, লিওনার্ডো ডিক্যাপ্রিও, টম ব্র্যাডি, মিক জ্যাগার, বিল গেটস, কিম কার্দাশিয়ান ও তার পরিবার, ডিজাইনার ডায়ান ভন ফুরস্টেনবার্গ ও তার স্বামী ব্যারি ডিলার। ইভাঙ্কা ট্রাম্প ও জ্যারেড কুশনার তাদের সন্তানদের নিয়ে আগেভাগেই পৌঁছান। গায়িকা ক্যাটি পেরির নাম থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাকে দেখা যায়নি।
গতকাল শনিবার ছিল বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা। অতিথিদের মধ্যে অনেকেই ঐতিহ্যবাহী পোশাকে হাজির হন, আর বেজোস-সানচেজের প্রতিটি মুহূর্ত ধরা পড়ে শত শত ক্যামেরায়। সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আয়োজকরা বিয়ের মূল অনুষ্ঠান স্থানান্তর করেন শহরের ব্যস্ত কেন্দ্র থেকে নিরাপদ ‘আর্সেনাল’ এলাকায়, যেখানে আমন্ত্রিত ব্যতীত কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
গভর্নর লুকা যায়া এই বিয়েকে ভেনিসের জন্য এক অর্থনৈতিক ও মর্যাদাগত চুম্বক বলেই অভিহিত করেছেন। তার ভাষায়, এই বিয়ের আনুমানিক খরচ ৪০ থেকে ৪৮ মিলিয়ন ইউরোর মধ্যে, যা ডলারে প্রায় ৫৬ মিলিয়ন। তার মতে, ট্রেভিসো ও ভেনিস বিমানবন্দরে ৯০টি প্রাইভেট জেট অবতরণ করেছে শুধু এই বিয়েকে কেন্দ্র করে, যা ভেনিসের জন্য পাঁচটি সুপার বোলের থেকেও বড় প্রচারমূলক সুযোগ।
তবে এই রাজকীয় আয়োজনকে ঘিরে সবার প্রতিক্রিয়া একরকম ছিল না। শহরের বহু সাধারণ নাগরিক এবং পরিবেশবাদী গোষ্ঠী ‘এক্সটিঙ্কশন রেবেলিয়ন’ (বিলুপ্তি বিদ্রোহ) এর পক্ষ থেকে ওঠে সমালোচনার সুর। বৃহস্পতিবার সেন্ট মার্কস স্কয়ারে তারা আয়োজন করে প্রতীকী প্রতিবাদ। মুখোশ পরা বর-কনের মূর্তি ও ব্যঙ্গাত্মক প্ল্যাকার্ডে তারা ধনীর দম্ভ এবং জলবায়ু বৈষম্যের ইঙ্গিত দেয়। এক প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘পৃথিবী জ্বলছে, কিন্তু চিন্তা কোরো না-লরেন সানচেজের ২৭টি পোশাকের তালিকা এখানে!’ যা বর-এর পোশাক পরিবর্তনের বিলাসিতার প্রতি তীব্র খোঁচা।
এই বিতর্কের মধ্যে বেজোস নিজেও পরিবেশ সুরক্ষার প্রতি দায়িত্ব দেখিয়েছেন। তিনি ভেনিস সংরক্ষণের সাথে যুক্ত তিনটি পরিবেশ গবেষণা সংস্থাকে প্রতিটিকে ১০ লাখ ইউরো করে অনুদান দিয়েছেন। এ তথ্য নিশ্চিত করেছে ভেনিসভিত্তিক সংস্থা ‘কোরিলা’।
শহরের প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভেনিস ঐতিহাসিকভাবেই একটি উন্মুক্ত ও স্বাগতমুখর শহর, যেখানে পোপ থেকে শুরু করে সাধারণ পর্যটক সবাইকে স্বাগত জানানো হয়েছে। মেয়র লুইজি ব্রুগনারো বলেন, ‘আমরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করি, কিন্তু কারা এখানে আসবে, ভালোবাসবে বা উৎসব করবে তা নির্ধারণের অধিকার কাউকে দিই না।’
এই তিন দিনে ভেনিস যেন রূপ নেয় এক চলমান সিনেমার সেটে, যেখানে বাস্তব ও রূপকথা পাশাপাশি হাঁটে। প্রশ্ন উঠছে-এই ব্যয়বহুল আয়োজন কি ভেনিসের জন্য এক আশীর্বাদ, নাকি শহরটিকে বিলাসের ভারে আরো দূরে ঠেলে দেওয়ার আরেক পদক্ষেপ? তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই বিয়ের কথা ইতিহাসে লেখা থাকবে দীর্ঘদিন।
আপনার মতামত লিখুন :