আইন মন্ত্রণালয়ে ‘প্যাকেজ ডিলিং’! চাকরির মেয়াদ বাড়াতে মরিয়া আরো ১৫ ‘মুজিবনগর কর্মচারী’


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : জুলাই ১৪, ২০২৫, ১২:২৪ অপরাহ্ণ /
আইন মন্ত্রণালয়ে ‘প্যাকেজ ডিলিং’! চাকরির মেয়াদ বাড়াতে মরিয়া আরো ১৫ ‘মুজিবনগর কর্মচারী’

আইন মন্ত্রণালয়ে ‘প্যাকেজ ডিলিং’! চাকরির মেয়াদ বাড়াতে মরিয়া আরো ১৫ ‘মুজিবনগর কর্মচারী’। প্রাপ্ত তথ্য মতে, কথিত ‘মুজিবনগর কর্মচারি’ এসব সাব-রেজিস্ট্রারদের জন্ম তারিখ এবং মুক্তিযুদ্ধকালিন তাদের বয়স নিয়ে রয়েছে ব্যাপক প্রশ্ন। মহানমুক্তি যুদ্ধের সময় কারো বয়স ছিলো আড়াই বছর, কারো বয়স সাড়ে ৪ বছর। কিন্তু তাদের দাবি, তাদের বয়স নাকি ওই সময় আরো বেশি ছিলো। এ নিয়ে মামলা- মোকদ্দমা হলে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের বয়স নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না’-মর্মে রায় দেন শেখ হাসিনার অনুগত উচ্চ আদালত।

এভাবে সংবাদ মাধ্যমের মুখ বন্ধ করে পুরো ‘কর্মকাল’ (৫৯ বছর) পার করেছেন মুজিব নগরের কর্মচারিরা। আইন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে স্বল্প বয়সের এই ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সাব রেজিস্ট্রারদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ এনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ ছিলো। কিন্তু মন্ত্রণালয় কখনো সেই সুপারিশ তামিল করেনি।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, জালিয়াতির মাধ্যমে চাকরি বাগিয়ে প্রায় সব ‘মুজিবনগর কর্মচারি’ আইন মন্ত্রণালয় থেকে সসম্মানে অবসরোত্তর সুবিধাদি নিয়ে চলে গেছেন। এখন অবশিষ্ট আছেন ১৪-১৫ জন ‘মুজিব নগর কর্মচারি’ সাব রেজিস্ট্রার। এদের অনেকে অবসর-পূর্ব ছুটিতে যাওয়ার লাইনে রয়েছেন। এ অবস্থায় তারা একটা ‘শেষ চেষ্টা’ করছেন। সেটি হচ্ছে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে চাকরির মেয়াদ অন্তত: এক বাড়ানোর। আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট দুই প্রভাবশালী কর্মকর্তার ‘ঘনিষ্টজন’ হিসেবে পরিচিত সাব রেজিস্ট্রার পুরো প্যাকেজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব নিয়েছেন।

প্যাকেজের ‘ টেস্ট কেস’ হিসেবে এরই মধ্যে দু’জন সাব রেজিস্ট্রারের ফাইল আইন উপদেষ্টার টেবিলে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রার্থী দু’জন হলেন ভোলা জেলার লালমোহনের সাব- রেজিস্ট্রার মো: মনজুরুল ইসলাম এবং গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলা সাব- রেজিস্ট্রার ওসমান গনি মন্ডল ।

প্রাপ্ত রেকর্ডপত্রে চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবিত নোটানুচ্ছেদে দেখা যায়, মুজিবনগর কর্মচারী ( মুক্তিযোদ্ধা) কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত সাব- রেজিস্ট্রারদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে বিভিন্ন ধরণের যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে ।

গত ১ জুন স্বাক্ষরিত নথিটিতে বিভিন্ন ধরণের বিধি-বিধানের দোহাই দিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো: সাইফুল ইসলাম, যুগ্ম-সচিব (প্রশাসন-২) এসএম এরশাদুল আলম, উপ-সচিব (রেজিস্ট্রেশন) মাহমুদুল ইসলাম , সিনিয়র সহকারি সচিব মোহাম্মদ আযিযুর রহমান স্বাক্ষর করেন। স্বাক্ষরের পর মতামতের জন্য পাঠানো হয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। জনপ্রশাসন থেকে ‘পজেটিভ’ মতামত আনতে মোটা অঙ্কের বাজেট বরাদ্দ রয়েছে-মর্মে জানায় সূত্রটি।

মুজিবনগর কর্মচারি দুই সাব রেজিস্ট্রারের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধির নথিতে স্বাক্ষরকারী আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (রেজিস্ট্রেশন) হাসান মাহমুদুল ইসলাম টেলিফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি ছুটিতে ছিলাম। অফিসে গিয়ে নথি না দেখে কিছুই বলতে পারবো না।

অন্যদিকে বয়স বৃদ্ধির আবেদনের সত্যতা স্বীকার করে ভোলার লালমোহন থানার সাব- রেজিস্ট্রার মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের আবেদনটি সব ‘ওকে’ করা। গত ১৮ জুন আইন উপদেষ্টা স্বাক্ষরও করেছেন। কিন্তু ৩ জুনের একটি প্রজ্ঞাপন দেখিয়ে আবেদনটি ঠেকিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা কখনো ‘মুক্তিযোদ্ধা’ দাবি করিনি। কারণ তখন আমাদের বয়স কম ছিলো। আমরা ছিলাম মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী কিংবা ‘সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা’। এখন এ নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। আইন মন্ত্রণালয় তাদের বয়স বৃদ্ধি না করলে বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন তিনি। একই বিষয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় কাপাসিয়ার সাব রেজিস্ট্রার ওসমান গনি ম-লের সঙ্গে। একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেন নি।

প্রসঙ্গত: মুজিবনগর কর্মচারী (মুক্তিযোদ্ধা) কোটায় নিয়োগ নেয়া সাব – রেজিস্ট্রারদের বিরুদ্ধে বয়স জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। রংপুর ভুরুঙ্গামারির একটি চক্র মুজিবনগর কর্মচারির ভুয়া কাগজ তৈরি করে। চক্রটি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিয়োগপত্র বাগিয়ে নেয়ার ঠিকা নেয়। জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ নেয়া এই সাব রেজিস্ট্রাররা জমির মূল্য কম দেখিয়ে সরকারকে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করা, জাল দলিল রেজিস্ট্রি করা, পরিত্যক্ত, খাস ও বন বিভাগের জমি রেজিস্ট্রি করা,দলিলে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।

অথচ আইন মন্ত্রণালয়ে তাদের বয়স বাড়ানোর যে প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয় তাতে এই দুর্নীতির তথ্য এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। মুজিবনগরখ্যাত এই রেজিস্ট্রাররা বিগত হাসিনা সরকারের দুর্নীতিগ্রস্ত আইন মন্ত্রী আনিসুল হককে মাসোহারা দিতেন। বিনিময়ে তাদের ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে অতিরিক্ত এক বছর চাকরির সুযোগ, ভালো পোস্টিং এবং বেপরোয়া দুর্নীতির অলিখিত লাইসেন্স দেয়া হতো।

আনিসুল হক এবং তার দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের নজরানা দিয়ে ‘মুজিবনগর কর্মচারি’ হিসেবে এখনো চাকরিতে রয়েছেন, গোপালগঞ্জ মোকসেদপুর উপজেলা সাব- রেজিস্ট্রার আবুল হোসেন,ফরিদপুরের সাব- রেজিস্ট্রার মিনতি দাস, চট্টগ্রাম রাউজানের সাব রেজিস্ট্রার আবু তাহের মোস্তফা কামাল, হাটহাজারির সাব রেজিস্ট্রার ওবায়েদউল্লাহ, লক্ষ্মীপুর সদর সাব রেজিস্ট্রার আবুল বাশার, বাগেরহাট, মংলা উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার স্বপন কুমার, পটুয়াখালি সদর সাব রেজিস্ট্রার মো: ফারুক পাটোয়ারি, কলাপাড়া সাব রেজিস্ট্রার কাজী নজরুল ইসলাম। তারা প্রত্যেকেই ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে চাকরির মেয়াদ এক বছর বাড়ানোর লাইনে রয়েছেন।

তবে মানে মানে কেটে পড়ার লাইনে রয়েছেন আরো অন্তত: ৬ সাব রেজিস্ট্রার। তারা কোনো তদবির করছেন না। কিন্তু দু’জন যদি এক বছর চাকরির মেয়াদ বাড়াতে সফল হন তাহলে তারাও একই সুবিধা চাইতে তৎপর হবেন মর্মে জানিয়েছে সূত্রটি। বাকিরা সরাসরি কোনো আবেদন না করলেও আইন মন্ত্রণালয়ে ‘প্যাকেজ ডিলিং’ এ অর্থের যোগান দিচ্ছেন তারা।