“সাংবাদিকদের কাছে আমি মাঝেমাঝে প্রশ্ন করি, আপনারা একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনি সাংবাদিক নাকি রাজনীতিবিদ? একবছর আগে জুলাই আন্দোলনের সময় সাংবাদিকদের ডেকে প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেছিলেন। উপস্থিত তাঁরা কে কি বলেছিলেন এটা তো জানেন! এটা সাংবাদিকতা? এটাকে আপনি আমি সাংবাদিকতা বলবো? রক্ষা করবো তাঁকে?
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সহ সভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, আগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলতে হবে, আমাদের বুঝতে হবে যে গণমাধ্যমে কাকে বলবো? তিনি আরো বলেন, “সাংবাদিকদের কাছে আমি মাঝেমাঝে প্রশ্ন করি, আপনারা একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করুন আপনি সাংবাদিক নাকি রাজনীতিবিদ? একবছর আগে জুলাই আন্দোলনের সময় সাংবাদিকদের ডেকে প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেছিলেন। উপস্থিত তাঁরা কে কি বলেছিলেন এটা তো জানেন! এটা সাংবাদিকতা? এটাকে আপনি আমি সাংবাদিকতা বলবো? রক্ষা করবো তাঁকে?
বুধবার (৬ আগস্ট) টায়সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা: সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও অভিযোগ নিষ্পত্তির আইনি কাঠামোর পর্যালোচনাগণমাধ্যমের স্বাধীনতাঃ অভিযোগ নিষ্পত্তি ও স্ব-নিয়ন্ত্রণের বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনাটি সিরডাপ (সেন্টার অফ ইন্টিগ্রেটেড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক) মিলনায়তন, ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন, সেন্টার ফর গভারন্যান্স স্ট্যাডিজ (সিজিএস) এর প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সহ সভাপতি ড. আলী রীয়াজ, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী।
এ ছাড়াও আলোচনায় আরো উপস্থিত ছিলেন পারভেজ করিম আব্বাসী, নির্বাহী পরিচালক , সিজিএস এবং সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সভাপতি, গণফোরাম, অধ্যাপক এস. এম. শামীম রেজা, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রেজওয়ানুল হক রাজা, প্রধান সম্পাদক, মাছরাঙা টেলিভিশন এবং চেয়ারম্যান, ট্রাস্টি বোর্ড, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার, রিয়াজ আহমেদ, নির্বাহী সম্পাদক, ঢাকা ট্রিবিউন, অধ্যাপক ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল, আহ্বায়ক, বিএনপি মিডিয়া সেল, আসিফ বিন আলী, পিএইচডি গবেষক, জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটি, আটলান্টা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মাহবুব মোর্শেদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস), মাহমুদা হাবীবা, সদস্য, বিএনপি মিডিয়া সেল ও যুগ্ম মহাসচিব, জাতীয়তাবাদী কৃষকদল, সোনিয়া জামান খান, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং সলিসিটার, ইংল্যান্ড ও ওয়েলস সুপ্রিম কোর্ট, কাজী জেসিন, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, মনজুরুল ইসলাম, নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন, জাহিদ নেওয়াজ খান, সিনিয়র সাংবাদিক, ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জিল্লুর রহমান বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের স্ব-নিয়ন্ত্রণ এবং অভিযোগ নিরসন নিয়ে আজকের এই আলোচনা। বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশনকে স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করবার জন্য সরকার ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রেস কাউন্সিলের নতুন কমিটি ঘোষনা করা হয়েছে এছাড়াও আরো অনেক কমিটি তৈরি করা হয়েছে কিন্তু আদতে সেই কমিটিগুলো কার্যকর কিছু করতে পারেনি। গণমাধ্যম সংস্কার নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা সরাসরিও অনেক নির্দেশনা দিয়েছেন কিন্তু বাস্তবে যা দেখেছি তা হলো তেমন কিছুই হয়নি।
পারভেজ করিম আব্বাসী বলেন, গত এক বছর বর্ষা বিপ্লবের পর মিডিয়া কি এখন স্বাধীন? পুরোপুরি স্বাধীন না হলেও অনেকাংশে স্বাধীন এইটা অস্বীকার করা যাবেনা। কিন্তু এখনো হ্যারেসমেন্ট, ট্যাগিং বা ফ্যাসিস্ট এগুলার যাই বলেন- সমালোচনা আমাদের বাঙালিদের অস্তিমজ্জায়, আমরা সমালোচনা নিতে পারিনা। মিডিয়াতেও এইটার প্রতিফলন হচ্ছে। আপনি যদি সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা ও করেন, আপনি সোশ্যাল মিডিয়া বা নানান প্লাটফর্মে সমালোচনার শিকার হবেন বা বিভিন্ন প্রেশার গ্রুপ সেখানে আবির্ভাব হবে।
মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, আমরা আজকে সংকটের মধ্যে আছি। প্রফেসর ইউনুস সরকারের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিলো, আমরা কি পেয়েছি? না, পাইনি। কিন্তু তিনি যে কাজটা করতে পারতেন সেটি তিনি করছেন না। বারো মাস-আঠারো মাস সময় নেয়ার দরকার ছিলো না। মিডিয়া সংস্কারে যেসব সুপারিশমালা সামনে আসছে, এই সুপারিশমালা থাকলে আগামী ১০ বছর কেন আগামী ১০০ বছরেও এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।
অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, মিডিয়া হাউজগুলোর সাংবাদিকরা ঠিকমতো বেতন ভাতা পান না। তাহলে আমরা কিভাবে ভালো সাংবাদিকতা আশা করব বা যাদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারব? বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আমার কাছে এখন মনে হয় সোনার পাথর বাটি।
অধ্যাপক এস. এম. শামীম রেজা বলেন, সেলফ রেগুলেশন এর ব্যাপারটি অনেক জোরেসোরে সামনে আসছে, তার মানে কি আমরা ধরে নিচ্ছি সাংবাদিকরা অন্য আইনী সুরক্ষা পাবেন না? তার উপর যে অবিচারগুলো হয়, যে চাপগুলো আসে সেগুলা নিরসন করা হবেনা, শুধু সেলফ রেগুলেশনে যাব! ব্যাপারটি যেন এরকম না হয়।
রেজওয়ানুল হক রাজা বলেন, মিডিয়া কমিশন রিপোর্ট জমা দেয়ার পর, কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ ১৫ দফা বিশিষ্ট একটি সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টার অনুরোধে যেটি তাৎক্ষনিক বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এর মধ্যে একটি ছিল প্রেস কাউন্সিল বিলুপ্ত করে প্রেস কমিশন গঠন করা। দুর্ভাগ্যবশত সেটি তোয়াক্কা না করে প্রেস কাউন্সিলকে পুনর্গঠন করা হয়েছে।
রিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল অলমোস্ট নন এক্সিস্টিং একটা ইন্সটিটিউশনে পরিনত হয়েছে, যা খুবই দুঃখজনক। এটি যদি না হত তবে আইসিটি এক্ট, ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট, সাইবার সিকিউরিটি এক্ট এগুলার আশ্রয়ে সাধারণ লোকদেরকে গ্রেফতারের মত ঘটনা ঘটতো না।
ডা. মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল বলেন, সংবাদপত্রের যেসব মিডিয়া হাউজ গুলো প্রতিষ্ঠিত তারা একটা কর্পোরেট গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন বা তারা সে জায়গা থেকে আছেন। সেখানে সংবাদপত্র ঠিক সংবাদপত্রের মত আচরণ করেনা। সে মিডিয়া হাউজ কিন্তু সে সংগঠন বা বড় গোষ্ঠীকে তার প্রতিরক্ষা দেয়ার জন্য কাজ করে। ফলে তাদের আর্থিক ভিত্তি হয়ত শক্ত হয়, কিন্তু তার বিপরীতে যখন প্রকৃত সাংবাদিকতার ব্যাপারটি আসে তখন সে আর্থিক ভিত্তিটা শক্ত থাকেনা।
আসিফ বিন আলী বলেন, মিডিয়া নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, তাঁরা রাজনৈতিক অর্থনীতির জায়গা থেকে কাজ করছে। কে সরকারে বা কে সরকারের বাইরে এটি বিবেচনা করে না। এখন হয়ত সালমান এফ রহমান নাই বা মোসাদ্দেক হোসেন ফালু নাই, কিন্তু আমরা হয়ত আরো কয়েকদিন পরে নতুন নাম পাবো।
মাহবুব মোর্শেদ বলেন, এতবড় একটা গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের আলোচ্য বিষয় থেকে ওয়েজ বোর্ড কিভাবে বাদ পড়ে গেলো? শুধু বাদ পড়ে যায়নি এটিকে বাইপাস করার জন্য অনৈতিকভাবে সরকারি চাকুরীর যে গ্রেড আছে, সে গ্রেডের নবম গ্রেড এখানে চাকুরির শুরুতে বাস্তবায়ন করার কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, আমি মনে করি গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন এর একটি বড় স্ক্যাম হলো সাংবাদিকদের অধিকার, সুরক্ষা, চাকুরীর নিশ্চয়তা, বিশেষ করে আর্থিক নিরাপত্তার যে ব্যাপারটি সম্পুর্ণভাবে এড়িয়ে। তারা একটি কর্পোরেট স্বার্থ এবং একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ বা ইন্টারেস্টকে সার্ভ করার জন্য এই সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট টি তৈরি করেছে। সাংবাদিকদের আইনী সুরক্ষা তো দূরের কথা তারা আর্থিক সুরক্ষার দিকেই নজর দেননি।
মাহমুদা হাবীবা বলেন, সাংবাদিকদের আর্থিক প্রণোদনা দরকার। তাদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলিকে উৎসাহিত করা উচিত। তিনি আরো বলেন গণমাধ্যম কমিশনের আইন বাস্তবায়নের ক্ষমতা থাকতে হবে।
ড. সোনিয়া জামান বলেন, রাইট টু ইনফরমেশন গণমাধ্যমের স্বচ্ছতার জন্যে একটা গুরুত্বপুর্ণ আইন। কিন্তু এটি ফ্রিকুয়েন্টলি আন্ডার ইউটিলাইজড বা অবস্ট্রাক্টেড। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইনী ও নীতিগত সংস্কারের দিকে বেশি মনযোগ দেয়া উচিত।
কাজী জেসিন বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহন করা পর তাদের উচিত ছিল একটি মিডিয়া তদন্ত কমিটি গঠন করা। যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গণমাধ্যমকর্মীদের কাছ থেকে রিপোর্ট চাইতে পারত। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তাদের সাথে কথা বলতে পারত, যারা একদম পক্ষপাতদুষ্ট তাদের জন্যে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা নিতে পারতো। অতীতে যারা তথ্য গোপন করেছিলো তাঁরা সেটি এখনো করছে কিনা এটি জানা দরকার ছিল, কিন্তু আমরা সেটি করতে পারিনি।
মনজুরুল ইসলাম বলেন, দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন নানাভাবে সংক্রমিত হচ্ছে। যত সময় যাচ্ছে গণমাধ্যম তত বেশি চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এখন আরেকটা নতুন চাপ কে আমার লোক কে আপনার লোক, কাকে বের করতে হবে, কাকে সংযুক্ত করতে হবে এই চাপ এটি গণমাধ্যমকে নষ্ট করছে।
ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, প্রেস কাউন্সিলের অবজেক্টিভ ও ফাংশন একবারে লিমিটেড নয়, একে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু এগুলোর বাস্তবায়ন দেখিনা বা খুবই অল্প সংখ্যক দেখা যায়। প্রেস কাউন্সিল যতটুকু সক্রিয় থাকার কথা সেটিও কিন্তু আমরা দেখতে পাই না।
আপনার মতামত লিখুন :