প্রতিবেদকঃ
ইশপের গল্প- ‘কচ্ছপ আর খরগোশের দৌড় প্রতিযোগিতা’ কাহিনী পড়েননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণা করবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রায় ১০ মাস আগে বার্তা দিয়েছেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন চলতে শুরু করেছে’। নির্বাচন পেছানো, নির্বাচন ঠেকানোর যতই ষড়যন্ত্র হোক, অর্থনৈতিক দৈন্যতা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে সাড়ে তিন মাস পর নির্বাচন যে হবে তা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু নির্বাচনে যে সব দল অংশগ্রহণ করবে সে দলগুলোর প্রস্তুতি কেমন? নির্বাচনী প্রস্তুতি ও প্রচারণা মাঠের চালচিত্র দেখে অনেকেই বর্তমানে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকে ‘খরগোশ’ আর জামায়াতকে ‘কচ্ছপের’ সঙ্গে তুলনা করছেন।
দৌঁড় প্রতিযোগিতায় (নির্বাচন) নামলেই ‘বিজয় নিশ্চিত’ ধরে নিয়ে খরগোশ দ্রুতই অর্ধেকটা পথ পাড়ি দিয়ে গাছের নিচে জিরাতে বসে। কচ্ছপ ধীরে ধীরে পথ চলে গাছের নিচে বিশ্রাম নেয়া খরগোশকে অতিক্রম করে চলে যায় শেষ প্রান্তে। যখন খরগোশের হুঁশ হলো তখন আর তার করার কিছুই ছিল না। অতিরিক্ত আত্মতুষ্টি-আত্মবিশ্বাস যে কখনো কখনো সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে, তা এই গল্পে বোঝানো হয়েছে।
শেখ হাসিনার পালানো এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের পর মোটা দাগে মনে হচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনে দেশের সর্ববৃহৎ এবং আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় বিএনপির একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াত। বাস্তবতা কি তাই বলে? জনসমর্থনের দিক দিয়ে বিএনপি বটবৃক্ষ হলে জামায়াত সুপারিগাছ। ফলে জামায়াত কখনোই বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারবে না। মূলত বিএনপির প্রতিপক্ষ এবং মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ভারত। নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি যাকে ক্ষমতায় আসতে না পারে সে লক্ষ্যে চানক্যনীতিতে নেমেছে ভারত। কয়েক মাস আগেও দেশি-বিদেশি দূতিয়ালির মাধ্যমে তারেক রহমানকে কব্জা করতে ব্যর্থ হয় দিল্লি। অতঃপর নির্বাচনের মাধ্যমে তারেক রহমানকে ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ভারত। আর এ কাজে পর্দার আড়াল থেকে জামায়াতকে সব ধরনের সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে।
জামায়াত প্রকাশ্যে ‘ভারত বিরোধী’ বক্তব্য দিলেও দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্কদের পরামর্শেই কর্মকৌশল নিচ্ছে। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির (পিআর) নির্বাচন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটÑ এগুলো মূলত আওয়ামী লীগকে আগামী সংসদে পুনর্বাসনে দিল্লির অ্যাজেন্ডা। জামায়াত সেগুলো নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। আর জামায়াতের সঙ্গে দেশের কওমি মাদরাসা-ভিত্তিক বিপরীত আকিদার ইসলামী ধারার দলগুলোর নেতাদের জোটবদ্ধ করতে ভারতের উত্তর প্রদেশের দারুল উলুম দেওবন্দের ইসলামী স্কলারদের ব্যবহার করছে। যে কৌশলে পাকিস্তানকে ‘সাইজ’ করে ভারত দীর্ঘদিনের শত্রু আফগানিস্তানের তালেবানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে; সে কৌশলে আগামী দেওবন্দ অনুসারী কওমি ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোকে মওদূদীপন্থি জামায়াতের নেতৃত্বের জোটসঙ্গী করার চেষ্টা করছে।
ভারতের ফুয়েল শক্তিতে জামায়াত নির্বাচনী দৌড়ে বিজয়ী হতে কচ্ছপের মতো নিরবচ্ছিন্ন প্রচারণা চালালেও বিএনপি এখনো কার্যত খরগোশের মতোই বিজয় সুনিশ্চিত আত্মবিশ্বাসে একটু ‘জিরিয়ে নিই’ বসে আছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন নির্বাচনে জামায়াত নয়; বরং বিএনপিকে ভারতের মতো শক্তির মোকাবিলা করতে হবে। এখন জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ভোটগুলো নিজেদের পক্ষে নিতে সুচিন্তিত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দেশে কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাক না ঘটলে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হচ্ছেই। কারণ দেশের অর্থনীতি চরম দুরবস্থায়। বিদেশিরাও জানিয়ে দিয়েছেন, অনিশ্চয়তার মধ্যে বিনিয়োগ করবেন না। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিনিয়োগ করবেন। ফলে নির্বাচন অবধারিত। এ অবস্থায় বিএনপি প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী- নির্বাচন হলেই তারা বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাবে। যার জন্য বিএনপির অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত এবং বিএনপির ভোটার হিসেবে পরিচিত সারা দেশের পীর-মাশায়েখ, মাজার-খানকার অনুসারী, মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এমনকি ইসলামী ধারার ছোট ছোট দলগুলো বিএনপি অনুসারী হিসেবে পরিচিতদের খোঁজ রাখার প্রয়োজন মনে করছে না। নির্বাচন হলেই ধানের শীষে ভোট দেয় এই দলগুলোর সঙ্গে বিএনপি নেতারা দু’-একটি বৈঠকের পর ফটোসেশন করলেও পরর্বর্তীতে যোগাযোগ রাখেনি। অথচ এই ছোট দলগুলোকে বিপুল অর্থব্যয়ে জামায়াতের পক্ষে নিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্করা। উদ্দেশ্য- বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া এবং তারেক রহমানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ঠেকানো। অথচ বিএনপি যেন ঘুমিয়েই রয়েছে।
পলাতক শেখ হাসিনা সর্বশেষ অডিও বক্তব্য ইউটিউবে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দিল্লির নাচের পুতুল হাসিনা বলেছেন, ‘আগে জামায়াত ধরনা দিয়ে বিএনপির কাছ থেকে ২০টি আসন নিয়েছিল। এবার বিএনপিকে ধরনা দিয়ে জামায়াতের কাছ থেকে ২০টি আসন নিতে হবে।’ হাসিনার এ বক্তব্যের নেপথ্যের রহস্য কি? যে জামায়াতকে হাসিনা নিষিদ্ধ করেছিল সেই হাসিনার মুখে জামায়াতের এত রাজনৈতিক শক্তির খবর? তাহলে কি বিএনপিকে সাইজ করতে হাসিনা নেপথ্যে থেকে দিল্লিকে জামায়াতের পক্ষে নামিয়েছে? সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে বেশ আলোচনাও হচ্ছে। গত ১৯ অক্টোবর জাতীয় প্রেস ক্লাবে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টির যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সে বার্তা দেয়।
জামায়াত ওয়াহাবি মতাদর্শী মওদূদী চেতনায় বিশ্বাসী দল। আর অন্যান্য দল কার্যত দেওবন্দ অনুসারী কওমি মাদরাসা-ভিত্তিক দল। আদর্শ ও আকিদায় জামায়াতের সঙ্গে ইসলামী দলগুলোর দূরত্ব যোজন যোজন মাইল। সারা জীবন এরা একে অপরের বিরুদ্ধে রাজনীতি করেছে। ‘তেল আর পানি একসাথে মিশে যাওয়ার’ মতোই তারা একসঙ্গে সংবাদ সম্মেলন এবং ভারতের অ্যাজেন্ডা পিআর পদ্ধতি নির্বাচন, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করছে।
অনেকেই বলছেন, রাজনৈতিক আদর্শিক কারণে রাজনীতির মাঠে সাপে-নেউলে সম্পর্ক হওয়ার পরও এই ইসলামী দলগুলো যুগপৎ কর্মসূচি পালনের নেপথ্যে দিল্লির হাত রয়েছে। হাসিনার বক্তব্যে সে ইঙ্গিত দেয়। কারণ দিল্লি কোনোভাবেই বিএনপি ও তারেক রহমানকে নিজেদের লোক মনে করছে না। তারেক রহমানের বিবিসি বাংলায় দেয়া সাক্ষাৎকারের বক্তব্যে দিল্লি বেজায় চটে যায়। বিএনপি ক্ষমতায় এলে দিল্লি যে অসুবিধা হবে তা দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্করা বুঝে গেছে। ওই সাক্ষাৎকারে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্পষ্ট বার্তা দেন। তিনি বলেছেন, ‘সবার আগে বাংলাদেশ। আমি আগে আমার দেশের মানুষের স্বার্থ দেখব, আমার দেশের স্বার্থ দেখব। ওটাকে আমি রেখে আপহোল্ড করে আমি যা যা করতে পারব, আমি তা–ই করব।’
বিবিসি বাংলা থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত? জবাবে তারেক রহমান বলেন, ‘অবশ্যই আমি আমার পানির হিস্যা চাই। অবশ্যই আমি দেখতে চাই না যে, আরেক ফেলানী ঝুলে আছে। অবশ্যই আমরা এটা মেনে নেবো না।’ পানির হিস্যা চাওয়া ও সীমান্ত হত্যার বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার থাকবেন কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে তারেক রহমান দুটি উদাহরণ দিয়ে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের পানির হিস্যা চাই। অর্থাৎ আমার দেশের হিস্যা, মানুষের হিস্যা আমি চাই, হিসাব আমি চাই। আমার যেটা ন্যায্য, সেটি আমি চাই। অবশ্যই ফেলানী হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আমি বোঝাতে চেয়েছি, আমার মানুষের ওপরে আঘাত এলে অবশ্যই সেই আঘাতকে এভাবে আমি মেনে নেবো না।’ ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শেখ হাসিনা দিল্লিতে গেছেন এবং সেখানে আছেন।
ভারতের সঙ্গে একটা সম্পর্কের শীতলতা দেখা গেছে এক বছর ধরে। যেমন ধরুন, সেটি যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে, ব্যবসার ক্ষেত্রে। সে ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আপনারা সরকারে এলে পরিবর্তনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন, এমন কোনো চিন্তা কি আপনাদের আছে? জবাবে তারেক রহমান বলেন, ‘এখন তারা (ভারত) যদি স্বৈরাচারকে সেখানে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের বিরাগভাজন হয়, সেখানে তো আমাদের কিছু করার নেই। এটি বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে শীতল থাকবে। সো, আমাকে আমার দেশের মানুষের সঙ্গে থাকতে হবে।’ বিএনপি ক্ষমতায় এলে তারেক রহমানকে যে হাসিনার মতো দিল্লির নাচের পুতুল বানাতে পারবে না, সেটা বুঝে গেছে ভারত।
যার জন্যই বিএনপি ও তারেক রহমানকে ঠেকাতে কোমর বেঁধে মাঠে নামিয়েছে। আর এটি করতে গিয়ে বন্ধুরাষ্ট্র পাকিস্তান-আফগানিস্তান যুদ্ধ বাধানো এবং চিরশত্রু হিসেবে চিহ্নিত কাবুলের তালেবান নেতাদের দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনে বন্ধুত্ব করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছে। বাংলাদেশের কওমি-ভিত্তিক ছোট দলগুলোর বেশির ভাগ নেতা দারুণ উলুম দেওবন্দ অনুসারী। সে কারণে দেওবন্দের বর্তমান ইসলামী স্কলারদের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলোর নেতাদের মওদূদীবাদী জামায়াতের সঙ্গে বসিয়েছে। অথচ ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরে অন্তরে’ কবিতার মতো বিএনপি ঘুমিয়ে রয়েছে।
বিএনপি এখনই সতর্ক না হলে ভারতের চানক্যনীতি ফর্মুলায় জামায়াত দেশের ইসলামী দলগুলোকে নিজেদের ছাতার নিচে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা চালাবে। অপ্রিয় হলেও সত্য, বিগত হাসিনা রেজিমে ১৫ বছর ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নামের ইসলামী দলটি হাসিনার অনুকম্পায় পরিচালিত হয়েছে। অনেকেই বলছেন, দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্কদের সঙ্গে ওই ইসলামী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে।
আর রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহিদ উর রহমান বলেছেন, ‘জামায়াতের নায়েবে আমির ড. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক শ্রীরাধা দত্তকে জানিয়ে দিয়েছেন, জামায়াত ভারতবিরোধী কোনো কাজ করবে না। দিল্লির সঙ্গে জামায়াতের মাখামাখি সম্পর্ক থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফেরাতে জামায়াত নেতা ডা. তাহের ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করা এবং জামায়াত-শিবিরের ৫০ লাখ তরুণ প্রস্তুত এমন বালখিল্য বক্তব্য দিয়েছিলেন।’ অবশ্য জামায়াতের আমির ‘আমরা ভারতবিরোধী নই’ ‘হাসিনাকে বারবার ফ্যাসিস্ট বললে ভালো লাগে না’ বক্তব্য দিয়েছেন।
শুধু তাই নয়, দিল্লির অনুকম্পা পাওয়ায় জামায়াত নেতারা এবার দুর্গাপূজায় ‘রোজা আর পূজা মুদ্রার এপিঠওপিঠ’ ‘পুজায় আসতে পেরে ধন্য হয়েছি’ এবং জামায়াত নেতারা গিতা পাঠ করেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাঁচ দফা দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচিতে জামায়াত এবং অন্য দলগুলোকে মিছিল করতে দেখা গেলেও গতকাল মাঠে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনকে মাঠে দেখা যায়নি। ইসলামী ধারার একাধিক দলের নেতা এ প্রতিবেদককে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে আকিদায় মেলে না। ফলে মওদূদীবাদী রাজনীতির সঙ্গে যেতে চাই না। কিন্তু বিএনপি যেন আমাদের সে দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সারা জীবন পৃথক রাজনীতি করলেও আওয়ামী লীগ ঠেকাতে বিএনপি প্রার্থীদের ভোট দিয়েছি। সফল হয়েছি নাকি ব্যর্থ হয়েছি সেটি ভিন্ন মূল্যায়ন; কিন্তু নির্বাচন হলেই বিজয় নিশ্চিত এমন ভাবনা থেকে বিএনপি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে না।
রাজনীতির আউলা বাজার কখন কোন দিকে ধাবিত হয় বলা যায় না; সে জন্যই ইসলামী ধারার ছোট দলগুলো হয়তো জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে শরিক হয়েছে। তবে বিএনপি যদি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার পথ অনুসরণ করেন তাহলে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন ছাড়া ইসলামী ধারার কোনো দলই ভারতের আঙ্গুলের নির্দেশে জামায়াতের সঙ্গে ফ্রন্ট করবে না। কারণ ইসলামী আন্দোলনের দায়বদ্ধতা আছে আওয়ামী লীগের কাছে। নেতারা জানান, জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে দিল্লির সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে।
জামায়াতের রাজনীতি নিয়ে কয়েক দিন আগে আমিরে হেফাজত আল্লামা মহিবুল্লাহ বাবুনগরী ‘জামায়াতে ইসলামী কোনো ইসলামী দল বলে মনে করি না। তাদের মাধ্যমে দেশে ইসলাম কায়েম হবে বলেও মনে করি না’-বক্তব্য দিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আমাদের আরেকটি প্রক্সি মওদূদীবাদী দলের প্রয়োজন নেই। এরই মধ্যে আধ ডজন প্রক্সি সক্রিয় আছে।’ উপদেষ্টার এই বক্তব্যে বেজায় চটেছিল জামায়াত। আবার ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ স্বাক্ষর ইস্যুতে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর শুরু করা তথাকথিত ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) আন্দোলন’ একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রতারণা ছাড়া কিছুই নয়’। তারপরও জামায়াত থেমে নেই। দিল্লির ছক অনুযায়ী অগ্রসর হচ্ছে।
বিএনপির সঙ্গে একসময় জোটবদ্ধ পরবর্তীতে যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে এমন ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দলের একাধিক নেতা জানান, জামায়াত ভারতের অ্যাজেন্ডা পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছেন এবং নির্বাচন পেছানোর চেষ্টায় পাঁচ দফা দাবির আন্দোলন করছে। এর কারণ বিএনপিকে ঠেকাতে ভারতীয় অ্যাজেন্ডা পিআর চাচ্ছে। অন্যদিকে বর্তমান ‘ক্ষমতা উপভোগ’। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেই যেন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জামায়াতকে ইজারা দিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন কোনো সেক্টর ও বিভাগ নেই, সেখানে জামায়াত সমর্থকরা নিয়ন্ত্রণ করছে না। অপ্রিয় হলেও সত্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সব সেক্টর অধিদফতর, পরিদফতর সব কিছু দখল করেছে জামায়াতের আমলারা।
বিগত দিনে যারা হাসিনার তাঁবেদার হিসেবে নিয়োগ-পদোন্নতি পেয়েছেন দিল্লির নীলনকশা অনুযায়ী, তাদের কেউ কেউ এখন জামায়াতি চেতনাধারী হয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী চেতনা ও জামায়াতি চেতনা একসঙ্গে মিলে বাংলাদেশপন্থি আমলাদের সাইজ করছে। নির্বাচন যতই বিলম্ব হবে, ততই জামায়াতি আমলাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে প্রশাসনযন্ত্র। অতএব জামায়াত চাইবে নির্বাচন বিলম্ব হোক। এ বাস্তবতা অুনধাবণ করেই বিএনপিকে সচেতন হতে হবে। নব্বইয়ের সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতারা ধরেই নিয়েছিলেন ক্ষমতায় যাচ্ছেন এবং কে কোন মন্ত্রণালয় নেবেন সে ভাগবাটোয়ারাও হয়। এমনকি টাকার বিনিময়ে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কেনাবেচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু নির্বাচনের আওয়ামী লীগ ধরাশায়ী হয় এবং বিএনপি ক্ষমতায় আসে। খরগোশের মতো আওয়ামী লীগ অধিক আত্মবিশ্বাস থেকে বিএনপিকে কচ্ছপের মতো তুচ্ছজ্ঞান করার পরিণতি ভোগ করেছে। বিএনপির নেতাদের সেখান থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত।
এটা ঠিক, বিএনপির ব্যাপক জনপ্রিয় ও বর্তমানে দলটির কাছাকাছি কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই। তাছাড়া বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর দল জামায়াতের জনসমর্থন অনেক কম। কিন্তু বিএনপি ও তারেক রহমান যাতে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে না পারেন, সে জন্য ভারত তৎপর হয়ে উঠেছে। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ভারতের সব চেষ্টা ভ-ুল হয়েছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে মাধ্যমে পুনর্বাসনে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবিও পাত্তা পাচ্ছে না। সে জন্যই বিএনপিকে ঠেকাতে বিকল্প পথ হিসেবে জামায়াতের উপর ভর করেছে। জামায়াতের নেতৃত্বে দেশের অন্যান্য ইসলামী ধারার দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং দেশের অবস্থানরত আওয়ামী লীগের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট দাঁড়িপাল্লার দিকে নিয়ে জামায়াতকে ক্ষমতায় বসানোর ছক এঁকেছে। ‘নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যাবই’ এমন মানসিকতায় বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ‘নাকে শর্ষের তেল’ দিয়ে ঘুমানোয় জামায়াত যেমন দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে; তেমনি ইসলামী ধারার রাজনৈতিক দল, পীর-মাশায়েখ, মাজার-খানকার খাদেম-অনুসারীরা আশাহত হয়ে পড়ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসলামী ধারার একাধিক দলের নেতা বলেছেন, বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের দ্রুতই জামায়াত ও আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত। বিশেষ করে ইসলামী ধারার দলগুলো যারা বরাবরই আওয়ামী লীগ ও জামায়াতবিরোধী হিসেবে পরিচিত সে সব দলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। ফটোসেশন নয়; জামায়াতের জোট থেকে বের করে এনে নির্বাচনের সঙ্গী করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে চানক্যনীতির ভারত আাগামী নির্বাচনে বিএনপি ও তারেক রহমানকে ঠেকাতে শত শত কোটি টাকা নিয়ে মাঠে নেমে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। আওয়ামী লীগ ও হিন্দু ভোটারদের ভোট দাঁড়িপাল্লায় নিতে যে জামায়াত নেতারা ‘রোজা ও পূজা মুদ্রার এপিঠওপিঠ’ বক্তব্য দেয়; সে জামায়াত ক্ষমতার লোভে হিন্দু ও আওয়ামী সমর্থনদের ভোট পেতে ভারতের হাতে দেশ বিপন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না। জামায়াত ও ভারতের আগ্রাসন থেকে দেশকে মুক্ত রাখার গুরুদায়িত্ব বিএনপিকে নিতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :