তুলনামূলক সস্তায় ভারতীয় সুতার অবাধ প্রবেশে বিপাকে পড়েছেন দেশের টেক্সটাইল শিল্প উদ্যোক্তারা। এমন পরিস্থিতিতে অনেক কারখানায় উৎপাদন কমেছে। কিছু কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে। একই সাথে গুদামগুলোতে অবিক্রীত সুতা জমার পরিমাণও বাড়ছে।
দেশের টেক্সটাইল শিল্পের সামনে নতুন সঙ্কট তৈরি করেছে ভারতীয় সস্তা সুতা। ভারত থেকে সুতা আমদানি সাম্প্রতিক সময় বৃদ্ধি পেয়েছে। তুলনামূলক সস্তায় ভারতীয় সুতার অবাধ প্রবেশে বিপাকে পড়েছেন দেশের টেক্সটাইল শিল্প উদ্যোক্তারা। এমন পরিস্থিতিতে অনেক কারখানায় উৎপাদন কমেছে। কিছু কারখানা ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে। একই সাথে গুদামগুলোতে অবিক্রীত সুতা জমার পরিমাণও বাড়ছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্যে দেখা যায়, গত তিন বছর ভারত তাদের টেক্সটাইল শিল্পে রফতানি বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে ধারাবাহিকভাবে নগদ প্রণোদনা, কর ছাড়, স্বল্পসুদে ঋণ এবং বিদ্যুৎ-গ্যাসে ভর্তুকি দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতীয় মিলগুলো প্রতি কেজি সুতায় ২০ থেকে ২৫ সেন্ট পর্যন্ত বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে গত দুই বছরে নগদ প্রণোদনা ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হয়েছে। এতে টেক্সটাইল মিলগুলো রফতানি বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান হারাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুধু রফতানি নয়, অভ্যন্তরীণ বাজারেও ভারতীয় সুতা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তথ্যে দেখা যায়, স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি ৩০ কাউন্ট সুতা বিক্রি হচ্ছে ২ দশমিক ৪৫ ডলার থেকে ৩ দশমিক ০৫ মার্কিন ডলার দামে। কিন্তু ভারতীয় সুতা চট্টগ্রাম বন্দরে ‘সিঅ্যান্ডএফ’ হিসেবে আমদানি করা যাচ্ছে প্রায় দুই দশমিক ১৯ ডলারে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ২৫ থেকে ৩০ সেন্ট সাশ্রয় হওয়ায় পোশাক প্রস্তুতকারকেরা দেশীয় সুতার পরিবর্তে ভারতীয় সুতার প্রতি বেশি ঝুঁকছেন।
নিটওয়্যার নির্মাতা ফতুল্লা ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল শামীম এহসান বলেন, দুই বছর আগেও তারা প্রায় সব সুতা দেশীয় মিল থেকে ক্রয় করতেন। এখন ৯০ শতাংশ সুতা ভারত থেকে আমদানি করেন। এতে প্রতি কেজিতে প্রায় ৩০ সেন্ট কম খরচ হয় হচ্ছে বলে তিনি জানান।
বিটিএমএর হিসাব অনুযায়ী, ভারতীয় সুতা আমদানি বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় কারখানায় সুতা বিক্রি ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এতে ঘাটতি সামাল দিতে নাপেরে অন্তত ৫০টির বেশি স্পিনিং মিল আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়েছে।
বিটিএমএ সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল নয়া দিগন্তকে বলেন, তাদের তালিকা অনুযায়ী ৫০টির বেশি মিল ইতোমধ্যে বন্ধ হয়েছে বা উৎপাদন বন্ধের পথে। তবে তাদের নাম প্রকাশ করলে আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি থাকায় তিনি তা করতে পারছেনা না বলে জানান।
নারায়ণগঞ্জের শাহ ফতেহউল্লাহ টেক্সটাইল মিলসের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শহীদ আলম জানান, তাদের গুদামগুলো অবিক্রিত সুতায় ভর্তি হয়ে গেছে। এমনকি কারখানার ভেতরে জায়গা বানিয়ে তারা সেগুলো রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। বিক্রি না হওয়ায় ইতোমধ্যে তারা ২৫ হাজার স্পিন্ডল বন্ধ করেছেন। আরো ২৫ হাজার বন্ধের প্রস্তুতি চলছে বলে তিনি জানান।
লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে সাধারণত ১০ শতাংশ স্টক থাকে, এখন তা ৫০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অবিক্রীত সুতা জমে নতুন সঙ্কট সৃষ্টি করছে বলে তিনি জানান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার ও চোরাই পথে আমদানি হওয়া সুতা স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে দেদার। ৩২ শতাংশ ওয়েস্টেজ অনুমোদনের সুযোগে বিপুল পরিমাণ সুতা অবৈধভাবে বাজারে ঢুকছে। তারা বলছেন, ১২ বিলিয়ন ডলারের দেশীয় পোশাক বাজারের মধ্যে ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ সুতা ও ফেব্রিকস অবৈধভাবে বিক্রি হয়, যা স্থানীয় মিলগুলোর চাহিদা কমার অন্যতম কারণ।
বিকেএমইর এক কর্মকর্তা মনে করেন, বন্ডের অপব্যবহার কেউ কেউ করলেও এর পরিমাণ খুবই কম। মূল সমস্যা হলো নীতি সহায়তায় ভারত এগিয়ে, আর বাংলাদেশ পিছিয়ে।
পোশাক খাতে অর্থায়নকারী একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে টেক্সটাইল খাতে তারা নতুন মেয়াদি ঋণ দিচ্ছেন না। ওয়ার্কিং ক্যাপিটালও সীমিত করা হয়েছে। কারণ অনেক মিল এখন ক্ষতির মধ্য দিয়ে চলছে, ঋণ ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে বলে তিনি মনে করেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ভারত থেকে সুতা আমদানি বেড়েছে ৪১ শতাংশ। বিটিএমএ বলছে, ২০২৫ সালে এই প্রবৃদ্ধি আরও বাড়ছে, যদিও চূড়ান্ত পরিসংখ্যান এখনো প্রকাশ হয়নি।
উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে, টেক্সটাইল শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে জরুরি ভিত্তিতে কয়েকটি পদক্ষেপ প্রয়োজন। এ জন্য নগদ প্রণোদনা অন্তত আবার ৪ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। বন্ডের অপব্যবহার ও অবৈধ সুতা আমদানির বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করতে হবে। বিদ্যুৎ গ্যাসের দাম স্থিতিশীল করা ও শিল্পবান্ধব ট্যারিফ নির্ধারণ। ভারত চীনসহ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সাথে ‘অ্যান্টি ডাম্পিং’ শুল্ক বিবেচনা করতে হবে। প্রযুক্তি আধুনিকায়নে স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা দিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও স্পিনিং শিল্প বছরে প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের উৎপাদন করে এবং রফতানি খাতের ৮০ শতাংশ সাপ্লাই চেইনে এই খাত পরোক্ষভাবে যুক্ত। তাই এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুধু কারখানা মালিক নয়, ব্যাংক, বীমা, পরিবহন, শ্রমবাজারসহ পুরো অর্থনীতি তার প্রভাব টের পাবে।
আপনার মতামত লিখুন :