সশস্ত্র বাহিনী দিবস ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষার অভিযাত্রা


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : নভেম্বর ২২, ২০২৫, ৮:২৭ পূর্বাহ্ণ /
সশস্ত্র বাহিনী দিবস ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষার অভিযাত্রা

ড. এ কে এম শামছুল ইসলাম

বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে এমন কিছু ঐতিহাসিক দিন আছে, যা শুধু ক্যালেন্ডারের নির্ধারিত তারিখ নয়, বরং বাংলাদেশের অস্তিত্ব, সামষ্টিক চেতনা, আত্মমর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের শাশ্বত ভিত্তি। ২৬ মার্চ, ৭ নভেম্বর এবং ২১ নভেম্বর—এই তিনটি তারিখ তেমনই তিনটি মাইলফলক। দেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম, রাষ্ট্র গঠনের অভিযাত্রা এবং সশস্ত্র বাহিনীর আদর্শিক ভিত্তিকে এক সুতায় গেঁথে আছে এই তিনটি দিন। ২৬ মার্চ ১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল এক অগ্নস্ফুিলিঙ্গ, যার আলোতে বাংলার লাখো মুক্তিকামী মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে।

আর ২১ নভেম্বর ১৯৭১ সালে সেনা, নৌ ও বিমান—এই তিন বাহিনীর সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে সেই ঘোষণায় সূচিত স্বাধীনতাসংগ্রাম পায় সংগঠিত এক সামরিক ভিত্তি, কৌশলগত দৃঢ়তা এবং বিজয়ের জন্য প্রয়োজনীয় মোমেন্টাম। জাতির সামরিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের আরেক অনিবার্য বাঁক—১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর, যেদিন সিপাহি-জনতার বিপ্লব এই ধারাকে আরো সুসংহত করে। তিনটি তারিখ, তিনটি ধাপ, একটি ধারাবাহিক ইতিহাস; স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সশস্ত্র বাহিনীর পূর্ণতা লাভ ও আন্ত বাহিনীর সমন্বয় এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দর্শনের আধুনিকায়ন।
২৬ মার্চ ১৯৭১।

পুরো জাতি যখন পাকিস্তানি বর্বরতার সামনে স্তম্ভিত, দিশাহারা; তখন চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার ডাক দেন। তাঁর এই ঘোষণা দুটি কাজ করে—প্রথমত, এটি জাতিকে সামরিক ও রাজনৈতিকভাবে দিকনির্দেশনা দেয়; দ্বিতীয়ত, বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করে যে মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ নয়, বরং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অকৃত্রিম আহবান। ঠিক এই ঘোষণার পরপরই সর্বস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত শক্তি ছিল বিকেন্দ্রীকরণ।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তুলনায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ অস্ত্রশস্ত্র, প্রশিক্ষণের ঘাটতি ও সম্পদের অভাব থাকা সত্ত্বেও বাঙালি সেনারা সেক্টর কমান্ডারদের নেতৃত্বে একের পর এক সাফল্য দেখাতে থাকেন। ভূমি, নদী ও আকাশ—সব জায়গায়ই পৃথকভাবে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। সেই প্রতিরোধকে পূর্ণাঙ্গ, সমন্বিত ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দেয় ২১ নভেম্বর ১৯৭১; ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের এক ঐতিহাসিক দিন। বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সমন্বিত এক সামরিক সংগঠনে রূপ নেয়। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে মুক্তিযুদ্ধ আর কেবল নিছক কোনো গেরিলা প্রতিরোধ নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতাসংগ্রাম।

২১ নভেম্বরের এই গঠন ছিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি সাংগঠনিক বিপ্লব। এই দিনটি মুক্তিযুদ্ধের সামরিক কৌশলকে স্থায়ী রূপ দেয়। আগে বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত অভিযানগুলো একত্র হয়, তথ্য ও গোয়েন্দা সমন্বয় বৃদ্ধি পায় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর চাপ বাড়ে। নৌ কমান্ডোদের বন্দর অভিযান, গেরিলা ইউনিটগুলোর সমন্বিত আক্রমণ এবং মুক্তিযোদ্ধা পাইলটদের ঝুঁকিপূর্ণ এয়ার-স্ট্রাইক—সবই এই সমন্বিত বাহিনী গঠনের ফল। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম যৌথ যুদ্ধের মডেল, যা পরবর্তী সময়ে দেশের সামরিক নীতির ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাসে ২১ নভেম্বর তাই কেবল একটি স্মরণীয় দিন নয়, বরং একটি কৌশলগত প্রয়াসের সূচনার দিন।

মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির সংগ্রাম ছিল একদিকে সামরিক প্রতিরোধ, অন্যদিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধ সামাজিক আন্দোলন। ২১ নভেম্বর গঠিত সেনা-নৌ-বিমান বাহিনী এই দুই দিককে একত্র করে। স্বাধীনতার পর একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত, সদ্যোজন্ম নেওয়া রাষ্ট্রের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রতিরক্ষা বাহিনীকে পুনর্গঠন করা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং জনগণের প্রত্যাশা ছিল বাহিনীকে দ্রুত শক্তিশালী করার প্রেরণা। তাই বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী শুধু সামরিক বাহিনী নয়, এ ছিল জাতির আত্মপরিচয়ের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেশের জনগণ এই বাহিনীকে শুধু রক্ষাকর্তা হিসেবে দেখেনি, তারা সামরিক বাহিনীকে দেখেছে স্বাধীনতা অর্জনের অগ্রদূত হিসেবে, এক গণমানুষের সেনাবাহিনী হিসেবে।

এখানেই আসে বাংলাদেশের সামরিক ইতিহাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ—১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের সংকট, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে অস্থিরতা দেশের প্রতিরক্ষাকাঠামোকে বিপন্ন করে তুলেছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে বিভাগীয় সেনা, সাধারণ জনতা এবং নিম্নপদস্থ সেনা সদস্যদের সমন্বয়ে ৭ নভেম্বর ঘটে এক ঐতিহাসিক ঘটনা, সিপাহি-জনতার বিপ্লব। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি আনুগত্য, সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারি, বাহিনীর মর্যাদা এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সামগ্রিক দিকনির্দেশনা নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিশেষত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। তিনি প্রবর্তন করেন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’, যা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের জনগণকেন্দ্রিক চেতনাকে আধুনিক, রাষ্ট্রভিত্তিক ও উন্নয়নমুখী এক নতুন কাঠামোতে উপস্থাপন। তাঁর দর্শন ছিল সুস্পষ্ট, রাষ্ট্রের পরিচয় হবে জনগণকেন্দ্রিক, সার্বভৌমত্ব হবে অটুট, সশস্ত্র বাহিনী হবে পেশাদার, দেশপ্রেমিক ও আন্তর্জাতিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন। এই দর্শন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে শুধু সামরিক শক্তিই দেয়নি, দিয়েছে নৈতিক শক্তি, জনগণের ভালোবাসা এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ববোধের নতুন মাত্রা।

১৯৭৫-৮১ সময়কালে তাঁর নেতৃত্বে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর ব্যাপক আধুনিকীকরণ শুরু হয়। বৃহত্তর প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন, আন্ত বাহিনী সমন্বয়, নতুন প্রশিক্ষণ পদ্ধতি, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি—সবকিছু এই সময়েই কাঠামোগতভাবে গড়ে ওঠে। তাঁর নেতৃত্বে বাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার হয়। দেশের প্রতিটি উন্নয়ন কর্মসূচি, কৃষি বিপ্লব, গণমানুষের আত্মনির্ভরতা—সব ক্ষেত্রেই সশস্ত্র বাহিনী ছিল তাঁর উন্নয়ন দর্শনের পরিপূরক অংশ। আজ বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী যে আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বাহিনী, যে বাহিনী জাতিসংঘের পতাকার নিচে সততা, শৃঙ্খলা ও মানবতার সেবা করে বিশ্বব্যাপী সুনাম অর্জন করেছে—এর প্রত্যক্ষ ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল সেই সময়েই।

২১ নভেম্বরের সশস্ত্র বাহিনী দিবস তাই কেবল একটি ইতিহাস স্মরণ নয়, এটি একটি ধারাবাহিকতার স্মরণ। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা, ২১ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের যৌথ সামরিক পূর্ণতা এবং ৭ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদার ও জনগণকেন্দ্রিক পুনর্জাগরণ—এই তিনটি অধ্যায় একে অপরকে পরিপূর্ণ করে। এই ধারাবাহিকতা ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং প্রতিরক্ষা কৌশল ও আদর্শকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। ২১ নভেম্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সশস্ত্র বাহিনী কখনোই বিচ্ছিন্ন কোনো শক্তি নয়, এটি জনগণের আবেগ, ইতিহাস, আত্মত্যাগ ও রাষ্ট্রীয় দর্শনের সম্মিলিত ফসল।

লেখক : সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক