অসময়ের বৃষ্টিতে উত্তরাঞ্চলে আমন ও সবজির ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : নভেম্বর ৩, ২০২৫, ৮:৪৭ পূর্বাহ্ণ /
অসময়ের বৃষ্টিতে উত্তরাঞ্চলে আমন ও সবজির ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা

ভারী ও হালকা বৃষ্টিপাতের কারণে রোপা আমন ধান ও শীতকালীন আগাম সবজির ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কৃষকদের কেউ কেউ বলছেন, তাদের রোপণ করা আমন ধান ক্ষেতে নুইয়ে পড়েছে। অনেকের সবজি ক্ষেতে পানি জমে সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। তবে কৃষি সংশ্লিষ্ট মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তাতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। বৃষ্টি আরো কয়েকদিন স্থায়ী হলে ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে।

আদমদীঘিতে বৃষ্টি ও ঝড়োহাওয়ায় পানিতে ডুবে গেছে ধানক্ষেত 

বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ভারী ও হালকা বৃষ্টিপাতের কারণে রোপা আমন ধান ও শীতকালীন আগাম সবজির ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কৃষকদের কেউ কেউ বলছেন, তাদের রোপণ করা আমন ধান ক্ষেতে নুইয়ে পড়েছে। অনেকের সবজি ক্ষেতে পানি জমে সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। তবে কৃষি সংশ্লিষ্ট মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তাতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। বৃষ্টি আরো কয়েকদিন স্থায়ী হলে ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পারে।

রায়গঞ্জ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় রোপা-আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অবিরাম বৃষ্টি ও দমকা বাতাসে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মাঠে পানি জমে ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে উপজেলার হাজারো কৃষক ফসল ঘরে তোলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে রায়গঞ্জ উপজেলায় মোট ১৯ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে রোপা-আমন ধানের চাষ হয়েছে। এসব জমি থেকে প্রায় সাড়ে ৮০ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

উপজেলার নলকা ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের কৃষক আবুল কালাম, রজব আলী, সোবাহান ও আশরাফ আলী জানান, রোপা-আমন ধান এখন ফুল থেকে থোর আসতে শুরু হয়েছে। এমন সময় ভারী বৃষ্টি ও দমকা বাতাসে ধান মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অনেক জমিতে ধান পুরোপুরি পানির নিচে চলে গেছে। এই তলিয়ে যাওয়া ধান ঘরে তোলা তো দূরের কথা, খড়ও পাওয়া যাবে না।

রায়গঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টির কারণে উপজেলার ১২০ হেক্টর জমিতে রোপা-আমন ধানের এবং ছয় হেক্টর জমিতে আবাদ করা সবজির ক্ষতি হয়েছে। এখন আমরা প্রণোদনা দিচ্ছি, সরকারের পক্ষ থেকে যদি পুনর্বাসন আসে তখন কৃষকদের তা দিতে পারব।

মহাদেবপুর (নওগাঁ) সংবাদদাতা জানান, আলু চাষ করে গতবছর লোকসানে পড়েছিলেন মহাদেবপুরের কৃষকরা। সেই লোকসান পুষিয়ে নিতে এবার আগাম আলু চাষ শুরু করেন তারা। কিন্তু কয়েকদিনের বৃষ্টিতে জমিতে পানি জমেছে। যেসব জমিতে আগাম আলু বপন করা হয়েছে, সেসব জমির আলুবীজ পঁচে যাচ্ছে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন আলু চাষিরা। এ ছাড়াও আমন ধান ও আগাম শীতকালীন শাক-সবজিরও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় আমন ধান চাষ হয়েছে এক লাখ এক হাজার হেক্টর জমিতে। আগাম শীতকালীন সবজি চাষ হয়েছে ১৫০ হেক্টর জমিতে। আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই হাজার হেক্টর জমিতে।

মহাদেবপুর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ বলেন, বৃষ্টি হলেও তেমন ভারী বর্ষণ হয়নি। সবেমাত্র আলু রোপণ শুরু হয়েছে। এরমধ্যে আলুর ক্ষতি হয়েছে ৫০ হেক্টর জমির, পালং শাক ১০ হেক্টর, লালশাক ১২ হেক্টর, মুলা ১৫ হেক্টর ও অন্যান্য সব সবজি প্রায় ৩০ হেক্টর। আমরা কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।

পোরশা (নওগাঁ) প্রতিনিধি, নওগাঁর পোরশায় কয়েক দিনের বৃষ্টিতে উপজেলার ১০৫ হেক্টর জমির আমন ধানের গাছ জমির ওপর নুয়ে পড়েছে। বিশেষ করে নিচু জমির পানি তাড়াতাড়ি না সরলে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা করছেন কৃষকেরা। তারা বলছেন, বৃহস্পতিবার রাত থেকে এ উপজেলায় গুড়ি-গুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টির সাথে ভারী বাতাসও বইছে। এতে উপজেলার নিচু জমিতে আমন ও রবি ফসলের ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।

গতকাল শনিবার সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন এলাকার আমন ধান পানিতে ডুবে গেছে অথবা পানির ওপর নুয়ে পড়েছে। তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের বারিন্দা গ্রামের কৃষক হুমায়ন কবির জানান, তাদের দুই বিঘা জমির ধান মাটিতে নুয়ে পড়েছে। ১৫ থেকে ২০ দিন পর এই ধান কাটার কথা ছিল। এই নুয়ে পড়া ধানের ভালো ফলন পাওয়া যায় না।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মামুনুর রশিদ জানান, এ উপজেলায় চলতি মৌসুমে ১৩ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আমনের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ১০৫ হেক্টর জমির ধান নুয়ে পড়েছে। এ সময়টা একটু সংবেদনশীল। তবে বৃষ্টির পানি সরে গেলে এ নুয়ে পড়ার কারণে জমির ধানে ক্ষতির তেমন আশঙ্কা নেই। এ ছাড়াও বৃষ্টিতে উপজেলার তিন হেক্টর জমির শীতকালীন আগাম আলু ও শাক-সবজির ক্ষেতে পানি জমে রয়েছে। এখনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। তবে আরো দুই-একদিন বৃষ্টি হলে মুলাজাতীয় সবজি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। রোপণ করা আগাম জাতের আলুও পচে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নলডাঙ্গা (নাটোর) প্রতিনিধি জানান, নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলায় গতরাতের হঠাৎ বৃষ্টি ও ঝড়ে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বেশিরভাগ জমির ধান পানিতে ভাসছে। এতে কৃষকেরা ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পড়বেন বলে ধারণা করছেন তারা।

শুক্রবার রাত ১০টা থেকে গতকাল শনিবার সকাল পর্যন্ত ব্যাপকহারে বৃষ্টিপাত ও ঝড় হয় নলডাঙ্গায়। অতি বৃষ্টি ও ঝড়ে পাকা আমন ধান জমিতে পড়ে যায়। এ ছাড়াও রোপণকৃত লাইলা বীজেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিন দেখা যায়, অনেক পাকা ও আধাপাকা আমন ধান পানিতে ভাসছে। অনেকে লাইলা পেঁয়াজ রোপণ করেছিলেন। সেসব জমিতে পানি জমে গেছে। এতে বেশির ভাগ বীজই নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া যেসব জমি বীজ বপনের উপযোগী করে রাখা হয়েছে, সেসব জমিতে বীজ রোপণ করতে আরো কিছুটা দেরি হবে।

আদমদীঘি (বগুড়া) রিপোর্টার জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মন্থা’র প্রভাবে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলায় বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় উঠতি আমন ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বুধবার রাতের প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে উপজেলার অনেক জমির ধানগাছ মাটিতে পড়ে গেছে, আধা-পাকা ধানের শীষ পানিতে তলিয়ে গেছে। দু’-এক দিনের মধ্যে পানি না শুকালে পানিতে ডুবে থাকা ধান পচে নষ্ট হবে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। এতে এ বছর আমন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে আদমদীঘিতে ১২ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। কৃষকরা আশা করেছিলেন এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি উৎপাদন হবে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় মন্থার কারণে গত কয়েক দিনের বৈরী আবহাওয়ায় বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় ধানখেত পানিতে তলিয়ে যায় এবং খেতের অনেক গাছ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এতে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

উপজেলার কেশরতা, ছাতিয়ান গ্রাম, চাঁপাপুর, আদমদীঘি ও সান্তাহার এলাকার বিস্তীর্ণ জমির ধানখেত এখন পানিতে তলিয়ে আছে। কৃষি অফিস সূত্র জানায়, এ উপজেলায় কৃষকরা আগাম জাতের বীনা-১৭, স্বর্ণা-৫ ও স্বর্ণা-৫১ জাতের ধান রোপণ করেছেন। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হওয়া মুষলধারে বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়ায় মাঠের ধানগাছ ভেঙে পড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।

কৃষক হামিদুল ইসলাম বলেন, দু’-এক দিনের মধ্যে পানি শুকিয়ে গেলে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যাবে। কিন্তু পানি যদি থেকে যায়, তাহলে সব ধান পচে যাবে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপজেলার কিছু এলাকায় আমন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। তবে পানি দ্রুত নেমে গেলে ক্ষতি অনেকটাই কমে আসবে।

খানসামা (দিনাজপুর) প্রতিনিধি জানান, দুই দিনের টানা ভারী বর্ষণে দিনাজপুরের খানসামায় পানিতে ডুবে আছে কৃষকদের রোপা আমন ধান। গত বুধবার দিবাগত রাতে ও শুক্রবার দিবাগত রাত থেকে সকাল পর্যন্ত টানা ভারী বর্ষষে ঘরবন্দী হয়ে পড়ে জনসাধারণ। গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও পুকুর পানিতে ভরে যায়। এ কারণে হতাশায় কপালে ভাঁজ পড়েছে কৃষকদের।

ছাতিয়ানগড় গ্রামের কৃষক গৌরাঙ্গ বলেন, আমন ধানের জমিতে যে পরিমাণ পানি ঢুকে আছে তাতে দ্রুত নিষ্কাশন না হলে কৃষকরা চরম ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়বে। যে দিকেই চোখ যায় সে দিকেই থইথই করছে পানি।

উপজেলা কৃষি অফিসার ইয়াসমিন আক্তার বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক মাঠে কৃষকের পাশে থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।

তারা বলছেন, ধান গাছ তুলে গোছা করে বেঁধে দিতে হবে। এর পর জমির পানি বের করে দিতে হবে। আবহাওয়া ভালো হলে বিপিএইচ ও পচানি ওষুধ স্প্রে করতে হবে।