আইন ও বিচারঃ বড় অর্জন ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে গ্রেফতারের নির্দেশ


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : নভেম্বর ১৬, ২০২৪, ১:১৪ অপরাহ্ণ /
আইন ও বিচারঃ বড় অর্জন ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে গ্রেফতারের নির্দেশ

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু তিন মাস বয়সী অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।

শেখ হাসিনার দলীয় প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতির পদত্যাগ, ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ, বিচারক বদলি, সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন, গুম কমিশন গঠন, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন,উচ্চ আদালতে ২৩ বিচারক নিয়োগ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন, টাইব্যুনালে প্রসিকিউটর নিয়োগ, অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে ডিএজি-এএজি নিয়োগ, সারাদেশের আদালতগুলোতে সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনার লক্ষ্যে জিপি,এজিপি,পিপি,এপিপি নিয়োগ হিসেব করলে অর্জন নেহায়েত কম নয়।

রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকালে গ্রেফতার সকল ছাত্র-জনতার মামলা প্রত্যাহার, কারামুক্তি করেছে আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।

নোবেল বিজয়ী বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ‘অন্তর্বর্তীকালিন সরকার’ শপথ গ্রহণ করে চলতিবছর ৮ আগস্ট। স্বৈরাচারি শেখ হাসিনা সংবিধানকে পরিণত করেছিলেন ‘ইচ্ছে-বিধান’ এ। যখন যেমনটি ইচ্ছে তেমন রকম ‘সংশোধনী’ এনে নিজের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী ও নিরঙ্কুশ করার চূড়ান্ত বন্দোবস্ত করেন। এ কারণে ২০১১ সালে সংবিধানে ‘পঞ্চদশ সংশোধনী’ আনেন। এর জন্য ব্যবহার করা হয় সুপ্রিমকোর্টকে।

কুখ্যাত সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের অলিখিত একটি রায়ের ভিত্তিতে শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠার জোরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি বিল পাস করিয়ে নেন। ফলে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা যে সংবিধান ফেলে রেখে গেছেন তাতে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ কিংবা ‘অন্তর্বর্তীকালিন সরকার’ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। ছাত্র-জনতার অভুত অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট ভারত পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এ ধরণের ‘পলাতক’ পরিস্থিতিতে কী করণীয়-এ বিষয়েও সংবিধানে কোনো নির্দেশনা নেই।

এ প্রেক্ষাপটে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তত: ৩ দিন দেশে কোনো সরকার ছিলো না। এ অবস্থায় ‘করণীয়’ নির্ধারণ ও নির্দেশনা চেয়ে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন সুপ্রিমকোর্টে রেফারেন্স চেয়ে পাঠান। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের একটি ‘উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার’ রয়েছে। প্রেসিডেন্ট এই অনুচ্ছেদের মোক্ষম ব্যবহার করে ৮ আগস্ট সকালে সুপ্রিমকোর্টে রেফারেন্স চেয়ে পাঠান। ওই সময় আদালতে ছিলো অবকাশে। অভ্যুত্থাণোত্তর হাসিনামুক্ত বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিগণ অবস্থান করছিলেন বাস ভবনে। এ অবস্থায় সুপ্রিমকোর্ট বসেন।

আইন, বিচারও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পাঠানো রেফারেন্সের ওপর সুপ্রিমকোর্ট অ্যার্টনি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামানের শুনানি গ্রহণ করেন। শুনানি শেষে তৎকালিন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি হয়। শুনানি শেষে সুপ্রিমকোর্ট সরকার গঠনের পক্ষে মতামত দেন। মতামত প্রদানের ভূমিকায় ওইসময় সৃষ্ট সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণ প্রসঙ্গ টানা হয়।

রেফারেন্সে সুপ্রিমকোর্ট থেকে বলা হয়, ‘সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালিন সরকার গঠনের কোনো বিধান না থাকায় উল্লিখিত প্রশ্নের বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে প্রদত্ত উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার প্রয়োগ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এই মতামত প্রদান করছে যে, রাষ্ট্রের সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণে জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের নির্বাহীকার্য পরিচালনার নিমিত্তে অন্তর্বর্তীকালিন ব্যবস্থা হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টা নিযুক্ত করতে পারবেন।’

সুপ্রিমকোর্টের এই মতামতের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন ‘অন্তর্বর্তীকালিন সরকার’। সংবিধানের বাইরে গিয়ে গঠিত এ সরকারে একমাত্র আইনি ভিত্তি বলতে প্রেসিডেন্টের নেয়া সুপ্রিমকোর্টের ওই রেফারেন্স।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের বেশ কয়েকজন প্রাক্টিসিং সিনিয়র আইনজীবী ও আইনজ্ঞ রয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী ছাত্র নেতৃবৃন্দের পছন্দ অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্বটি দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক ড. আসিফ নজরুলকে। তিনি দায়িত্ব নিয়েই বেশকিছু প্রতিশ্রুতির কথা ব্যক্ত করেন। অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনী,ছাত্রলীগ-র‌্যাবের গুলিতে শহীদ ছাত্র-জনতা হত্যার বিচার, মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতারকৃতদের দ্রুত মুক্তি। সে অনুযায়ী তিনি বহু মামলা প্রত্যাহারও করেন।

কিন্তু ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন, লাখ লাখ বিরোধী নেতাকর্মী হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন, হাজার হাজার আলেম-উলামা মিথ্যা মামলায় হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন-তাদের কারামুক্তির সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা ছিলো না। মামলা প্রত্যাহার না করায় এখনো বহু বিএনপি এবং আলেম-ওলামাকে মামলয় হাজিরা দিতে হচ্ছে।

সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলার আসামি হিসেবে ‘ দৈনিক ইনকিলাব’র সাংবাদিকসহ অনেকে এখনো হাজিরা দিচ্ছেন। হাসিনার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলায় অনেক নিরীহ মানুষ আসামি হয়েছে। কথিত আসামিদের অনুপস্থিতিতে একতরফা বিচার হয়েছে। ১০ বছর করে কারাদ- হয়েছে। এসব ভুক্তভোগীরা এখনো গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মিথ্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্তদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আসেনি এখনো।

ড. আসিফ নজরুল দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দুই মাসে কিছু প্রসিকিউটর এবং বিচারক বদলি ছাড়া আইন ও বিচার বিভাগে অগ্রগতি ছিলো মন্থর। ১০ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন হাসিনার ফ্যাসিজমের দোসর এবং স্বঘোষিত ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’খ্যাত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি এম.ইনায়েতুর রহিমসহ ৬ বিচারপতি।

১১ আগস্ট প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয় হাইকোর্ট বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে। এরপর আইন ও বিচার বিভাগের কার্যক্রম খুব একটা চোখে পড়েনি। আইন ও বিচার বিভাগের কার্যক্রমে ধীরগতি নিয়ে সমালোচনা হতে থাকে। এ প্রেক্ষাপটে গত ৯ অক্টোবর হাইকোর্ট বিভাগে একদিনে নিয়োগ দেয়া হয় ২৩ বিচারপতি।

নিযুক্ত বিচারপতিগণের কাউকে কাউকে নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। বিশেষত: আইনজীবীদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেয়া বিচারপতিদের ৭০ ভাগই ছিলেন সুপ্রিমকোর্ট বারের ‘নন-প্রাক্টিসিং’ আইনজীবী। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পক্ষের সুপারিশ এবং উপদেষ্টাগণের সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্কই প্রাধান্য পেয়েছে-মর্মে সমালোচনা ওঠে।

শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যান ৫ আগস্ট। কিন্তু তার দীর্ঘ স্বৈরাচারের একনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে ‘ইনট্যাক্ট’ থেকে যান হাইকোর্ট বিভাগের দুর্নীতিবাজ,আওয়ামী দলকানা ও বিতর্কিত বিচারপতিগণ। হাসিনার দীর্ঘ ফ্যাসিজমের দোসর উচ্চ আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছিলো না। সরকারের প্রথম দুই মাস বিতর্কিত এইসব বিচারপতিগণ সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং সম্মান উপভোগ করেছেন পুরোদমে।

পওে তাদের অপসারণের দাবিতে ৩০ সেপ্টেম্বর আবারো সুপ্রিমকোর্টে জড়ো হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা। দুর্নীতিবাজ বিচারপতিদের অপসারণে তারা ২৪ ঘন্টা সময় বেঁধে দেন। কিন্তু বিচারপতি অপসারণের সংবিধানসম্মত কোনো পথ খোলা না থাকায় ছাত্র-জনতার দাবি অনুযায়ী বিচারপতিদের অপসারণ করা যায় নি। পরে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের আশ্বাসক্রমে কর্মসূচি স্থগিত রাখেন ছাত্র-জনতা। বলা হয়, বিতর্কিত ১২ বিচারপতিকে আর বেঞ্চ দেয়া হবে না। এতে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

গত ২০ অক্টোবর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা বহাল রেখে আপিল বিভাগে পেন্ডিং থাকা রিভিউ পিটিশন নিষ্পত্তি হয়। এ রিভিউ পিটিশন করে যায় শেখ হাসিনার সরকার। কিন্তু সেটি নিষ্পত্তির কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছিলো না। অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের আইনমন্ত্রণালয় রিভিউ পিটিশন শুনানির উদ্যোগ নেয়।

এর ফলে সংবিধানে পুনর্বহাল হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল। এর মধ্য দিয়ে বিচারপতি অপসারণের এখতিয়ার ফিরে আসে এই কাউন্সিলের হাতে। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার সরকার সংবিধানে ষোড়শ সংশোধনী বিল পাস করার মধ্য দিয়ে কাউন্সিলের কার্যক্রম রুদ্ধ করে দিয়েছিলো। সেটি পুনরুদ্ধার অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের বড় সাফল্য।

জুলাই-আগস্ট গণত্যার বিচার অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক প্রতিশ্রুতি। এ প্রতিশ্রুত পূরণে ৮ সেপ্টেম্বর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলামকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটর নিয়োগ করে। এর মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর আন্তরিকতার প্রকাশ ঘটে। ২৫ অক্টোবর নিয়োগ দেয়া হয় আরো পাঁচ প্রসিকিউটর। তদন্ত সংস্থায়ও নিয়োগ দেয়া হয় তদন্ত কর্মকর্তা।

এর আগে ১৪ অক্টোবর পুনর্গঠন করা হয় ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’। হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারকে চেয়ারম্যান এবং বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ এবং জেলা ও দায়রা জজ মো: মতিউল হক এনাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

১৭ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল শুরু করে কার্যক্রম। প্রথম দিনই মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ভারত পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা, আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনাসহ আসামিদের গ্রেফতার করে আগামি ১৮ নভেম্বরের মধ্যে হাজির করার কথা রয়েছে।

এরই মধ্যে এ মামলায় বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। শেষ মাসের এই গতিকে সরকার ধরে রাখবে, আরো বেগবান হবে-এমন প্রত্যাশা আইন ও বিচার অঙ্গনের মানুষদের।