এ মাসেই রায়ের জন্য প্রস্তুত হবে গণহত্যার হাসিনার নির্দেশ অপরাধের মামলা, সর্বোচ্চ শাস্তি চায় শহীদ পরিবার


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : অক্টোবর ৭, ২০২৫, ১২:২৯ অপরাহ্ণ /
এ মাসেই রায়ের জন্য প্রস্তুত হবে গণহত্যার হাসিনার নির্দেশ অপরাধের মামলা, সর্বোচ্চ শাস্তি চায় শহীদ পরিবার

গত বছর জুলাই-আগষ্টে ছাত্র জনতার আন্দোলনে গুলী চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে প্রায় দেড় হাজারের বেশি মানুষকে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার। এভাবে মানুষকে হত্যা করতে গুলী চালানোর নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের

গত বছর জুলাই-আগষ্টে ছাত্র জনতার আন্দোলনে গুলী চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে প্রায় দেড় হাজারের বেশি মানুষকে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার। এভাবে মানুষকে হত্যা করতে গুলী চালানোর নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে বিচার চলছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালের বিরুদ্ধে। চলতি অক্টোবর মাসেই রায়ের জন্য প্রস্তুত হবে হত্যার নির্দেশ দেয়ার অপরাধের এ মামলাটি। তারপর রায়ের জন্য অপেক্ষমান থাকবে।

এ মামলার অপর আসামী সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজস্বাক্ষী হয়ে দোষ স্বীকার করে আদালতে সাক্ষ্য দেয়ায় সাবেক আইজিপি আব্দুল্লাহ আল মামুন অভিযোগ থেকে ক্ষমা পেয়েছেন। অপর দুই আসামীর বিষয়ে রায় ঘোষণা করা হবে। ইতোমধ্যে সকল সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তার জেরা চলছে। জেরা শেষে যুক্তিতর্কের জন্য সপ্তাহখানেক সময় লাগতে পারে। তারপর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান থাকবে বলে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন থেকে জানা গেছে। এদিকে শহীদ পরিবারের সদস্যরা শেখ হাসিনাসহ গণহত্যার সাথে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানিয়েছে।

ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলায় বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। মামলার মূল তদন্ত কর্মকর্তার (আইও) জবানবন্দি শেষে জেরার কার্যক্রম চলছে। জেরা শেষ হতে বেশ কয়েকদিন সময় লাগতে পারে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হওয়ার পরপরই নিয়ম অনুযায়ী আসামিপক্ষের সাফাই সাক্ষী হওয়ার কথা। কিন্তু শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক থাকায় তাদের পক্ষে সাক্ষ্যগ্রহণের সুযোগ নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলায় যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন শুরু হবে। যুক্তি-তর্ক শেষে রায়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হবে। তবে কবে নাগাদ মামলায় রায় হতে পারে তা কেবল আদালত তারিখ ধার্য করার পরই জানা যাবে।

প্রসিকিউটরদের ভাষ্য, সাক্ষ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে তারা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগই ট্রাইব্যুনালে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন।

প্রসিকিউটর এম এইচ তামিম বলেন, যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য এক সপ্তাহের মতো সময় লাগবে। এরপর মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হবে। রায় কখন ঘোষণা হবে, সেটি নির্ভর করছে আদালতের ওপর।

শহীদ পরিবারগুলোর অনেকেই এই বিচারপ্রক্রিয়ার শুরু থেকেই নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হওয়ায় তারা কিছুটা স্বস্তি পেলেও এখন চান দ্রুত রায়।

শহীদ মিরাজের বাবা আব্দুর রব বলেন, চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। আমার মিরাজ কী অপরাধ করেছিল? যারা আমাদের সন্তানদের হত্যা করেছে, তাদের ফাঁসি ছাড়া কোনো বিচার হতে পারে না।

শহীদ আলভীর বাবা আবুল হাসান বলেন, যেহেতু সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে, ট্রাইব্যুনাল চাইলে এক-দেড় মাসের মধ্যেই রায় দিতে পারে।

মামলার বিষয়ে প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম জানান, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ৫৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের সর্বশেষ সাক্ষী হিসেবে এই মামলার মূল তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মো. আলমগীর জবানবন্দি দিয়েছেন। এখন তার জেরা চলছে। তার জেরার মধ্য দিয়েই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করা হবে। এই মামলার দুজন আসামি পলাতক থাকায় তারা সাফাই সাক্ষ্য (ডিফেন্স উইটনেস) দেওয়ার সুযোগ পাবেন না। ফলে আইওর সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হচ্ছে। এরপর আমরা এক সপ্তাহ সময় নেব যুক্তিতর্ক প্রস্তুতির জন্য। এরপর ডিফেন্সের যুক্তিতর্কে কত দিন লাগবে সেটা তারা জানেন।

মামলার কার্যক্রম কবে শেষ হওয়ার সময় সর্ম্পকে তিনি বলেন, অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে না হলে নবেম্বরের প্রথম সপ্তাহের দিকে শেষ হতে পারে। তবে রায় ঘোষণার এখতিয়ার সম্পূর্ণ মাননীয় ট্রাইব্যুনালের। তবে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউশন টিম আশাবাদী।

প্রসিকিউশনের দাবি, তারা ২১টি ভিডিওসহ যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন, যা অপরাধগুলোকে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। তবে আসামিপক্ষ তা মানতে নারাজ। রাষ্ট্রনিযুক্ত আসামিপক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, বিচারে নানা ত্রুটি রয়েছে। আমরা সেগুলো সাক্ষীর মাধ্যমে তুলে ধরতে পারলে আসামি খালাস পেতে পারে। তিনি মনে করেন, যুক্তিতর্ক শেষ হতে আরও দুই সপ্তাহ লাগতে পারে। রায় লিখতে একটু সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে এই মামলার রায় নভেম্বরে হতে পারে।

হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলায় জবানবন্দি দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম। এছাড়া তদন্ত কর্মকর্তার কাছে মরহুম লেখক-গবেষক ও রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমরের দেওয়া জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল। সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এই মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন। দৈনিক আমারদেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানসহ অনেকেই সাক্ষ্য দিয়েছেন। মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের সময় বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ প্রদর্শন ও কল রেকর্ড শোনানো হয়।

প্রসিকিউশন জানায়, তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য শেষে উভয়পক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে। যুক্তি-তর্ক শেষ করার পরে মামলার রায়ের জন্য দিন ধার্য করবেন ট্রাইব্যুনাল। সে হিসেবে চলতি অক্টোবর মাসের ২০ তারিখের মধ্যে শেষ হতে পারে এই মামলার বিচারিক কার্যক্রম। রায়ের জন্য প্রস্তুত থাকবে। রায় হতে পারে নভেম্বর বা ডিসেম্বরে।

গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এই পাঁচটি অভিযোগে তাদের বিচার করা হচ্ছে। অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।

গত ১ জুন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই আসামিদের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ আমলে নেন। আমলে নেওয়া পাঁচ অভিযোগ হলো

প্রথম অভিযোগ : শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আমলে নেওয়া অভিযোগের প্রথমটিতে বলা হয়, শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই চীন থেকে ফিরে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন। এ সময় আন্দোলনরত ছাত্রদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে অভিহিত করে ছাত্র- জনতার ওপর নির্যাতনের উসকানি দেওয়া হয়। আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন তার অধীনস্থ বাহিনীকে হামলার জন্য সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে নির্দেশ দেন। এতে করে রাজধানীর মিরপুর, আশুলিয়া, যাত্রাবাড়ি, গাজীপুরসহ সারা দেশে নিহতদের জানাজা ও সৎকার করা, হাসপাতালে লাশ হস্তান্তরে বাধা প্রদান করা হয়। এসব কর্মকাণ্ড করে আসামিরা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।

দ্বিতীয় অভিযোগ: জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় সুপিরিয়র কমান্ডার শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভিসি) এস এম মাকসুদ কামাল ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এসব ফোনকলে আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্রের ব্যবহার করার কথা বলা হয়। নির্দেশ পেয়ে হেলিকপ্টার থেকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলী করা হয়। এসব ফোনের অডিও ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে। নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এছাড়া সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বাহিনীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারের জন্য নির্দেশনা দিয়ে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং ২৫ হাজার মানুষকে আহত করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।

তৃতীয় অভিযোগ: ১৬ জুলাই রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলী করে হত্যা করা হয়। পরে তার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চারবার পরিবর্তন করা হয়। এ ঘটনায় নিহত আবু সাঈদের সহপাঠীদের আসামি করে মামলা করে পুলিশ। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে এই হত্যা, তথ্য গোপন ও মিথ্যা মামলা করা হয়। এসবের নির্দেশ দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তিন আসামি।

চতুর্থ অভিযোগ: গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় চাঁনখারপুল এলাকায় শহীদ আনাসসহ ছয়জনকে গুলী করে হত্যা করা হয়। সুপিরিয়র কমান্ডার হিসেবে এ ছয়জনকে হত্যা করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।

পঞ্চম অভিযোগ: ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা এক দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে আসার সময় আশুলিয়ায় ছাত্রদের গুলী করে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা হয়। এ ঘটনার নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। এই আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন করে প্রসিকিউশন।