দক্ষিণ বঙ্গের জেলাগুলো থেকে কালের আবর্তনে তাল গাছের পাতায় বোনা সুনিপুণ কারুকার্য খচিত বাবুই পাখির বাসা হারিয়ে যাচ্ছে। কবি তাই -বাবুই পাখিকে ডাকি বলিছে চড়াই, কুঁড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই, আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে, তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে’ । কবি রজনীকান্ত সেনের কালজয়ী এ ছড়ায় বাবুই পাখির প্রধান আস্তানা গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য তালগাছে এখন আর দেখা যায় না, তেমনি দেখা মেলে না ছড়ার নায়ক বাবুই পাখিও।
দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জেলা খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বিভিন্ন উপজেলা মাঠের ধারে, পুকুরের পাশে, রাস্তার পাশে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে আপন ঘর নির্মাণে ব্যস্ত শিল্পমনা বাবুই পাখির কিচিরমিচির শব্দ। এখন এসব দৃশ্য শুধুই কল্পনার বিষয়। পরিবেশ বিপর্যয় ও লবণাক্ততার কারণে তালগাছ সহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের অকাল মৃত্যু হওয়ায় বাবুই পাখির বাসা অনেকটা বিলীন হতে চলেছে। ১৪-১৫ বছর আগেও গ্রাম-গঞ্জের মাঠ-ঘাটে তাল গাছে দেখা যেত বাবুই পাখির বাসা।
কিন্তু এমন একটা সময় ছিল যখন গ্রামাঞ্চলে প্রচুর তাল, নারিকেল ও খেজুর গাছ দেখা যেতো। বাবুই পাখির কিচিরমিচির শব্দ এবং তাদের শৈল্পিক বাসা তৈরি মানুষকে আনন্দিত করতো। এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে গ্রামে। একদিকে ওর লবণাক্ততার কারণে গাছ গাছালির অকাল মৃত্যু অন্যদিকে জলাশয়সহ কৃষি জমি ভরাট করা হচ্ছে।
গাছপালা কেটে বসতির জন্যে অট্টালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তাই এখন আর আগের মতো গ্রামাঞ্চলের রাস্তার ধারে, বাড়ির পাশে সেই তালগাছ, খেজুর গাছ যেমন দেখা যায় না তেমনি দেখা মিলে না শৈল্পিক বাবুই পাখিরও। গ্রামের একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ হারিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে শৈল্পিক বাবুই পাখিও।
একসময় বিভিন্ন প্রজাতির বাবুই পাখি দেখা যেত। এরমধ্যে অনেক বাবুই পাখি এখন বিলুপ্তির পথে। টিকে আছে কিছু দেশী বাবুই। বাসা তৈরির জন্য বাবুই পাখির পছন্দের তাল, নারিকেল, সুপারি ও খেজুর গাছ কমতে থাকায় আবাসস্থল সংকট দেখা দিয়েছে। এছাড়াও কৃষিকাজে কীটনাশক ব্যবহার করায় দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে এ পাখি। তালগাছ আর বাবুই পাখির বাসা এ যেন একই বৃন্তে দুটি ফুল। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটিকে নিয়ে ভাবা যায় না। শুধু তালগাছকে নিয়ে ভাবলে, বাবুই পাখির বাসা এমনিতেই যেন চোখে ভেসে আসে।
সরেজমিনে খুলনা জেলার পাইকগাছা, কয়রা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা উপজেলা ও সাতক্ষীরা জেলার তালা, কলারোয়া, আশাশুনি, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, যশোরের চৌগাছা, শার্শা, ঝিকরগাছা উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এক সময় উপজেলার যেসব গ্রামে সারি সারি তালগাছ ছিল, সেইসব তালগাছের পাতায় পাতায় মোড়ানো থাকতো বাবুই পাখির বাসা।
পাশাপাশি পাখির কিচিরমিচির শব্দে গ্রামাঞ্চল মুখরিত থাকতো। সেইসব গ্রামে এখন আর তেমন তালগাছও নেই, বাবুই পাখির বাসাও নেই। আষাঢ় মাস আসার আগে থেকেই বাবুই পাখি বাসা বুনতে শুরু করতো। তখন কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত থাকতো পুরো গ্রাম। এখন হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি তালগাছ চোখে পড়ে। এখন আর মুখরিত হয়না কিচিরমিচির শব্দে গ্রামবাংলার জনপদ।
পাইকগাছা উপজেলার সোলাদানা গ্রামের মো: আলী মাহমুদ গাজী বলেন, ছোটবেলায় দেখতাম গ্রামের মাঠের ধারে, পুকুরের পাশে, রাস্তার পাশে একপায়ে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছগুলোর মধ্যে অনেক বাবুই পাখির বাসা ছিল। কিন্তু এখন বাবুই পাখির বাসা আর দেখা যায় না। বাবুই পাখির বাসাটি এখন বিলবতি হতে বসেছে। আমাদের পুরো এলাকা জুড়ে মাত্র কয়েকটি তালগাছ আছে বাবুই পাখির বিচরণ ধরে রাখার জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।
সকল উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাগণ বলেন, বৈরী আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে অনেক প্রাণি হারিয়ে যাচ্ছে। অসংখ্য প্রজাতির পশু, পাখি, কীট-পতঙ্গ আমাদের পরিবেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে এছাড়া অনেক গুলো বিলুপ্তির পথে। দিন দিন তালগাছ ও খেজুরগাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে,যে কারণে বাবুই পাখি এখন বিলুপ্তের পথে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে পাখির অরণ্য সৃষ্টি করতে হবে।
আপনার মতামত লিখুন :