ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতন হলেও গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড পুলিশ কর্মকর্তারা নয় মাসেও অধরা। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা সদর দপ্তরের বিশেষ মনিটরিং সেল থেকে সারাদেশে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও নিপীড়নের আদেশ সমন্বয়ের কাজ করেছেন তারা এখনো এসবি, সিআইডি, নৌপুলিশ, পুলিশ স্টাফ কলেজ ও পুলিশ হেডকোয়ার্টারের বিভিন্ন শাখায় কর্মরত। আর বিগত সময়ে বৈষম্যের শিকার পুলিশ কর্মকর্তারা আজও বঞ্চিত।
পেশাদার বঞ্চিত কর্মকর্তাদের রেখে ছাত্র-জনতার হত্যা-আহত করার সাথে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে নতুন নতুন পদে পদায়ন করা হচ্ছে। এমনকি ‘গুলি করি, মরে একটা। একটাই যায় স্যার। বাকিগুলো যায় না।’ ফেসবুকে ভাইরাল এমন বক্তব্য দেয়া ছাত্র-জনতাকে হত্যার সাথে জড়িত ডিএমপির সাবেক ডিসি ইকবাল হোসাইনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছাত্র-জনতার খুনের সাথে জড়িত পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা নানা কৌশলে বর্তমান সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের শেল্টার নিয়ে আত্মগোপনে আছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর পুলিশ বাহিনী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। এর পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে ধীরে ধীরে কাজে ফেরে পুলিশ। বলতে গেলে এক সপ্তাহের বেশি সময় পুলিশবিহীন নিষ্ক্রিয় থাকা অবস্থায় চলে দেশ। অনেকের মতে ২০০ বছরের ইতিহাসে পৃথিবীর কোন দেশে এমনটা হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, পুলিশ স্টাফ কলেজের রেক্টর হিসেবে কর্মরত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতাকে হত্যার নির্দেশ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। যেসব কর্মকর্তা পুলিশ সদর দপ্তরে বসে সারাদেশের ছাত্র-জনতাকে গুলিকরাসহ কঠোর হস্তে দমনের নির্দেশ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই এখনও পুলিশ সদর দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ ডেস্কে রয়েছেন।
নৌপুলিশের প্রধান পদে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় সিআইডিতে থেকে খুনি পুলিশ কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়), স্বরাষ্ট্র সচিব ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রতিনিয়তই ছাত্র-জনতার খুনে অভিযুক্ত অনেক কর্মকর্তার সাথে বৈঠক করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসপি মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইনের মতো ভয়ংকর খুনি পুলিশ বাহিনীতে কম নয়। যারা নয় মাসেও ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব পলাতক খুনিরা গ্রেফতার না হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেফতার অভিযান নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা পুলিশ সদর দপ্তরের সঠিক মনিটরিং ও দিক নির্দেশনা না থাকায় রাজধানীসহ সারাদেশে অপরাধী এবং জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে ছাত্র-জনতার খুনের সাথে জড়িতরা গ্রেফতার হচ্ছে না। অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল এজেন্ডার একটি হওয়া উচিত ছিল ছাত্র-জনতার খুনের সাথে জড়িত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত সময়ের প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনৈতিকভাবে বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পুলিশের প্রতি মানুষের ক্ষোভ আছে, কারণ পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন না করে আওয়ামী সরকারের ক্যাডার হিসেবে কাজ করেছে। কমান্ডিং থেকে নিচের স্তর পর্যন্ত সবাই অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে সময় পার করেছে। রাজনৈতিক নেতাদের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করতে হয়েছে পুলিশকে। অন্যায় আদেশ পালন করার পাশাপাশি সবকিছুতে পুলিশ টাকা নিয়েছে বলে একটা দুর্নাম ছিল। এ অবস্থা থেকে পুলিশকে বেরিয়ে আসতে হবে। এখন আর কোনো রাজনৈতিক দলের চাপ নেই। পুলিশে শুধু খুনি নয়, অনেক আবর্জনাও রয়েছে। এগুলো দূর করতে হবে। পেশাদার, সৎ, যোগ্য ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেয়ার মাধ্যমে পুলিশের হারানো সুনাম ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার ও বেনজীর আহমেদসহ প্রায় এক হাজার পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতাকে হত্যা-হত্যার চেষ্টার অভিযোগ এনে সারাদেশে শত শত মামলা দায়ের করা হয়েছে। এদের মধ্যে সাবেক আইজিপিসহ ৫৬ জনকে গ্রেফতার করা হলেও অনেকেই এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। হত্যা মামলার আসামি হয়েও অনেক পুলিশ কর্মকর্তা অফিস করছেন।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং পুলিশ সদর দপ্তরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেই। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, হত্যা মামলার আসামি পুলিশ কর্মকর্তাদের সবাই পতিত আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। এসব কর্মকর্তারা বিগত ১৫ বছর নানা ধরনের অপরাধের সাথেও সম্পৃক্ত ছিলেন এমন বহু অভিযোগ রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে পুলিশে অসন্তোষ বাড়বে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর ইনকিলাবকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার উপর হামলা ও হত্যা মামলাসমূহ পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করছে। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের অবস্থান শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে।
আপনার মতামত লিখুন :