জনপ্রশাসন থেকে প্রজ্ঞাপন জারিঃ রাতের ভোটের কারিগর ডিসিদের ওএসডি


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৫, ১১:১০ অপরাহ্ণ /
জনপ্রশাসন থেকে প্রজ্ঞাপন জারিঃ রাতের ভোটের কারিগর ডিসিদের ওএসডি

২০১৮ সালে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ আমলের বহুল আলোচিত বিতর্কিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ৪৫ জন সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) ওএসডি করা হয়েছে। এর মধ্যে আগে ১২ জন ডিসিকে ওএসডি করা হয়েছিল, এবার ৩৩ জন সাবেক ডিসিকে ওএসডি করা হয়েছে। তারা দিনের ভোট রাতে করার গুরুতর অভিযোগ প্রমাণ পাওয়ায় বর্তমান সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। গতকাল বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত পৃথক পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে সকল কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২০১৮ সালে ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের বহুল আলোচিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে করার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। দিনের ভোট আগের রাতে সম্পন্ন করায় সহায়তা করেছিলেন তখনকার রিটার্নিং কর্মকর্তা বা জেলা প্রশাসকরা (ডিসি)। দীর্ঘ পাঁচ বছর আট মাস পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতন হলেও গত কয়েক মাস ধরে ওইসব ডিসিদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। গত ৬ মাস তারা প্রশাসনের সর্বত্র দাপিয়ে দায়িত্ব পালন করেছে।

স্বৈরাচারের অপমানজনক বিদায়ের পর কিছু সময় তারা আতঙ্কিত থাকলেও বর্তমানে ফুরফুরে মেজাজে অফিস করেছেন। প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাতে ভোট সম্পন্ন করা ডিসিরা দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। তারা জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে ফ্যাসিবাদীদের সর্বাত্মক সহায়তা করেছেন। স্বৈরাচারের ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে তারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এত কিছুর পরও প্রশাসনে তাদের সুদৃঢ় অবস্থান নিয়ে স্বৈরাচারের রোষানলে পড়া বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বেড়ে চলছিল। দুর্নীতিবাজদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার বিনিময়ে তারা পদোন্নতি এবং প্রাইজ-পোস্টিং পেয়েছেন। হয়েছেন আর্থিকভাবে লাভবান।

এছাড়া বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরাম মনে করছে, স্বৈরাচার ও তাদের দোসর সাবেক ডিসিরা দেশদ্রোহী অপরাধ করেছেন। তাদের চাকরি থেকে অপসারণ করে সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। একই দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএসএ) সাবেক নেতারা। তারা বলছেন, সেই ডিসিদের বিরুদ্ধে উদাহরণ দেওয়ার মতো শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান।

সম্প্রতি সরকারের সিদ্ধান্ত মতে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ভোট আগের রাতে সম্পন্ন করা ডিসিদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তারা আর কোনো পদোন্নতি পাবে না। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের সময় তাদের পদোন্নতি দেওয়া হবে না বলে দাবি করা হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের আহ্বায়ক এবিএম আব্দুস সাত্তার ইনকিলাবকে বলেন, স্বৈরাচারের ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে সহায়তাকারী ডিসিরা দেশদ্রোহী অপরাধ করেছেন। তাদের প্রশাসন থেকে অপসারণ ও গ্রেফতার করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সরকারের ভালো সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং কর্মকর্তা পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের নামে তালিকা চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে দুদক। এর পরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন নেওয়া হয়েছে। তা যাচাই-বাছাই শেষে গতকাল বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এসব কর্মকর্তাদের ওএসডি করা হয়েছে।

তারা হলেন, সাবেক ঢাকা জেলার ডিসি ও বর্তমান যুগ্মসচিব আবু সালেহ মো. ফেরদৌস খান, নারায়ণগঞ্জের সাবেক ডিসি রাব্বী মিয়া, নরসিংদী জেলার সাবেক ডিসি সৈয়দ ফারজানা কাওনাইন, মানিকগঞ্জ জেলার সাবেক ডিসি এস এম ফেরদৌস, মুন্সীগঞ্জ জেলার সাবেক ডিসি সায়লা ফারজানা, ফরিদপুর জেলার সাবেক ডিসি উম্মে সালমা তানজিয়া, শরীয়তপুর জেলার সাবেক ডিসি কাজী আবু তাহের, মাদারীপুর জেলার সাবেক ডিসি মো. ওয়াহেদুল ইসলাম, গোপালগঞ্জের সাবেক ডিসি মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান সরকার, রাজবাড়ি জেলার সাবেক ডিসি ও অতিরিক্ত সচিব মো. শওকত আলী, কিশোরগঞ্জ জেলার সাবেক ডিসি মো. সারোয়ার মোর্শেদ চৌধুরী, টাঙ্গাইল জেলার সাবেক ডিসি মো. শহিদুল ইসলাম, বি-বাড়িয়া জেলার হায়াত-উদ-দৌলা খান, কুমিল্লা জেলার সাবেক ডিসি মো. আবুল ফজল মীর, চাঁদপুর জেলার সাবেক ডিসি মো. মাজেদুর রহমান, লক্ষ্মীপুর জেলার সাবেক ডিসি অঞ্জন চন্দ্র পাল, ফেনীর জেলার সাবেক ডিসি মো. ওয়াহেদুজ্জামান, নোয়াখালী জেলার সাবেক ডিসি ও যুগ্মসচিব তন্ময় দাস, চট্টগ্রাম জেলার সাবেক ডিসি মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন, কক্সবাজার জেলার সাবেক ডিসি কামাল হোসেন, বান্দরবান জেলার সাবেক ডিসি মো. দাউদুল ইসলাম, রাঙ্গামাটি জেলার সাবেক ডিসি এ কে এম মামুনুর রশিদ, খাগড়াছড়ি জেলার সাবেক ডিসি মো. সাহেদুল ইসলাম, সিলেটের সাবেক ডিসি ও (বর্তমান মিনিস্টার সৌদি বাংলাদেশ দূতাবাস) কাজী এমদাদুল ইসলাম, মৌলভীবাজার জেলার সাবেক ডিসি তফায়েল ইসলাম, সুনামগঞ্জ জেলার সাবেক ডিসি মোহাম্মদ আবদুল আহাদ, হবিগঞ্জ জেলার সাবেক ডিসি মাহমুদুল কবির মুরাদ, ময়মনসিংহ জেলার সাবেক ডিসি ড. সুবোধ চন্দ্র বিশ্বাস, নেত্রকোনা জেলার সাবেক ডিসি ময়নুল ইসলাম, শেরপুর জেলার সাবেক ডিসি ও বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্মসচিব আনারকলি মাহবুব, জামালপুর জেলার সাবেক ডিসি আহমেদ কবির (ওএসডি), পঞ্চগড় জেলার সাবেক ডিসি ও বর্তমানে যুগ্মসচিব সাবিনা ইয়াসমিন, গাইবান্ধা জেলার সাবেক ডিসি সেবাঞ্জিন রেমা ও আব্দুল মতিন, ঠাকুরগাঁও জেলার সাবেক ডিসি ড. কে এম কামরুজ্জামান, কুড়িগ্রাম জেলার আলোচিত সাবেক ডিসি মোসা. সুলতানা পারভীন, দিনাজপুর জেলার সাবেক ডিসি মো. মাহমুদুল আলম, নীলফামারী জেলার সাবেক ডিসি নাদিয়া শিরিন, রংপুর জেলার সাবেক ডিসি এনামুল হাবিব, নওগাঁ জেলার সাবেক ডিসি মো. মিজানুর রহমান, জয়পুরহাট জেলার সাবেক ডিসি মোহাম্মদ জাকের হোসেইন, বগুড়া জেলার সাবেক ডিসি ফয়েজ আহমেদ, নাটোর জেলার সাবেক ডিসি মোহাম্মদ গোলামুর রহমান, পাবনা জেলার সাবেক ডিসি মো. জসিম উদ্দিন, সিরাজগঞ্জ জেলার সাবেক ডিসি কামরুন নাহার সিদ্দিকা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সাবেক ডিসি এ জেড এম নুরুল হক, সাতক্ষীরার সাবেক ডিসি এস এম মোস্তফা কামাল, যশোর জেলার সাবেক ডিসি মো. আবদুল আউয়াল, বাগেরহাট জেলার সাবেক ডিসি তপন কুমার বিশ্বাস, খুলনা জেলার সাবেক ডিসি মোহাম্মদ হেলাল হোসেন, ঝিনাইদহ জেলার সাবেক ডিসি সরোজ কুমার নাথ, চুয়াডাঙ্গা জেলার সাবেক ডিসি গোপাল চন্দ্র দাস, কুষ্টিয়া জেলার সাবেক ডিসি মো. আসলাম, মেহেরপুর জেলার সাবেক ডিসি মো. আতাউর গনি, নড়াইল জেলার সাবেক ডিসি আঞ্জুমান আরা, মাগুরা জেলার সাবেক ডিসি মো. আলী আকবার, বরিশাল জেলার সাবেক ডিসি এস এম আজিয়ার রহমান, পিরোজপুর জেলার সাবেক ডিসি আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন, ভোলা জেলার সাবেক ডিসি মোহাম্মদ মাসুদ আলম, ঝালকাঠি জেলার সাবেক ডিসি হামিদুল হক, পটুয়াখালী জেলার সাবেক ডিসি মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী এবং বরগুনা জেলার সাবেক ডিসি কবির মাহমুদ।

জানা গেছে, গত ২০১৮ সালে বিএনপি-জামায়াতকে মেরে-কেটে ক্ষমতায় বসতে শেখ হাসিনা দু’হাতে অর্থ ছিটান। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, পুলিশ, আমলা, ডিসি, এসপিদের দেওয়া হয় এ অর্থ। দলীয় ক্যাডারদের মাঝে অর্থ বিলানো হয় বস্তা বস্তা। তবে সরকারি হিসাবে এ অর্থের পরিমাণ ছিল ৭শ’ কোটি টাকা। এর মধ্যে ‘পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে’ পুলিশকে আগাম অর্থ বরাদ্দ দেন ২শ’ ৭২ কোটি টাকা। অ্যাডভান্স পাওয়া টাকার মধ্যে ৬৩ কোটি ২২ হাজার টাকা। র‌্যাবকে ১০ কোটি ২০ লাখ ২৯ হাজার। কোস্টগার্ডকে ১ কোটি ৫৬ লাখ। বিজিবিকে ৩৩ কোটি ২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। আনসার ও ভিডিপিকে দেওয়া হয় ১শ’ ৬৩ কোটি ৮১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।

ওই বছর ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় কথিত এ ‘নির্বাচন’। এর আগে ওই বছর ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ জানিয়েছিলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাতওয়ারি ৭শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ওই নির্বাচনে একেকটি কেন্দ্রে ১৪ থেকে ১৬ জন নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। প্রতি নিরাপত্তাকর্মীকে প্রাপ্য অর্থের দ্বিগুণ, তিন গুণ করে দেওয়া হয়। যে নির্বাচন পরবর্তীতে ‘রাতের ভোটের নির্বাচন’ কুখ্যাতি পায়। বাস্তবে জালিয়াতি ও প্রতারণাপূর্ণ নির্বাচনে মানুষকে ভোট দিতে হয়নি।

ভোট গ্রহণের আগের রাতে দলীয় কর্মী, পুলিশ এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যালট বাক্স ভরে রাখেন। প্রহসনের ওই নির্বাচনের যাবতীয় খরচ কার্যত ছিল রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় এবং আত্মসাৎ। নির্বাচনের নামে অর্থ অপচয়, আত্মসাৎ, জালিয়াতি ও জাতির সঙ্গে প্রতারণার বিষয়ে অনুসন্ধানে মাঠ কাজ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ প্রতিবেদন পাওয়ার পরে গতকাল প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।