প্রতিবেদকঃ
নীলফামারীর ডিমলায় বুড়ি তিস্তা জলাধার খননে স্থানীয়দের সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বিরোধ তুঙ্গে উঠেছে। কৃষকদের সেচ সুবিধা নিশ্চিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বুড়ি তিস্তায় জলাধার খননের প্রকল্প হাতে নিয়েছে অধিগ্রহণকৃত ১২১৭ দশমিক ৬১ একর জমিতে। ৩ হাজার ১শ’ ৫৮ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা নিশ্চিতে প্রকল্পটি ২০২১ সালে একনেকে পাশ হয়। তারপরেই কার্যক্রম চালু হলে স্থানীয়দের বাধার মুখে পড়তে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। হামলা-ভাঙচুরে স্থানীয়দের বিরুদ্ধে মামলা হয় বেশ কয়েকটি। কিন্তু স্থানীয়দের দাবী, পানি উন্নয়ন বোর্ড অধিগ্রহণের টাকা দিয়েছে মাত্র ১০৪ একর জমির।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডেরও বিএস রেকোর্ড মূলে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৯শ’ একর জমি। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, প্রকল্পটি ষাটের দশকে বাস্তবায়নের পর থেকেই প্রায় ৫ বছর ডুুবে ছিলো স্থানীয়দের ফসলি জমি। এ কারণে ১৯৬৯ সালের ২৫ জুন ফসলের ক্ষতিপূরণও দেয়া হয়েছিল ক্ষতিগ্রস্তদের। কিন্তু বর্তমানে এসব জমিতে আবাদ হচ্ছে ধান, ভুট্টা আলু, মরিচ, পেঁয়াজসহ বছরে তিন থেকে চারটি ফসল। আর এই জমি জুড়ে আছে ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ৫টি মৌজা।
স্থানীয়রা বলছেন, এসব জমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করে ৫ মৌজার মানুষ। একারণে প্রকল্পটি বাতিলসহ মামলাগুলো প্রত্যাহারের দাবি তাদের। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বুড়ি তিস্তার পার ঘেঁষা জমিতে নানা ধরণের ফসলের আবাদ হচ্ছে। আর ব্যারেজ এলাকায় দেখা গেছে জলাধার খননের জন্য প্রস্তুত ঠিকারদারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এসব ফসলি জমি রক্ষার্থে দফায় দফায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভও করেছে স্থানীয়রা। প্রকল্প বাতিলের দাবিতে জেলা প্রশাসক বরাবর স্বারকলিপিও প্রদান করেছে তারা।
এদিকে পনি উন্নয়ন বোর্ডও আবার মানববন্ধন করেছেন প্রকল্পে বাধা প্রদান কারীদের বিরুদ্ধে। মানববন্ধনে তারা প্রায় দেড় বছর ধরে ঝুলে থাকা প্রকল্পটির কাজ অব্যাহত রাখার দাবি জানান। ৭৫ বছর বয়সি কুঠির ডাঙ্গা মৌজার কৃষক আব্দুর রউফ বলেন, আইয়ুব খানের আমলে কালীগঞ্জ নামক স্থানে বুড়ি তিস্তা ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়। ব্যারেজটি নির্মাণের পর থেকে কোনো কাজে আসেনি। গেট বন্ধ করে রাখায় ৫ বছর আশেপাশের জমিতে কোনো আবাদ হয়নি।
এ কারণে ফসলের ক্ষতিপূরণ বাবদ আমাদেরকে ৬৯ সালে টাকা দেয়া হয়েছিল। আমরা তো কখনও অধিগ্রহণের টাকা পাই নাই। এই জমিতে আমরা বছরে তিন থেকে চারটি ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি। এখন এই জমিতে নাকি জলাধার খনন করবে গত কয়েক বছর ধরে ধুম চলছে। বাধা দিতে গেলে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের এমপি আফতাব উদ্দিন সরকার মিলে আমাদের ওপর নানা নির্যাতন করে। নিরীহ মানুষদের আসামিও করে তারা। সেই থেকে আমরা চরম আতঙ্কে আছি। পুলিশের তাড়ায় ঠিকভাবে বাড়িতেও থাকতে পারছি না। আমরা চাই এই প্রকল্পটি বাতিল করা হউক। এতোগুলো ফসলি জমি নষ্ট করে কিভাবে জলাধার তৈরির অনুমতি দিয়েছে শেখ হাসিনা সরকার।
রামডাঙ্গা মৌজার অলিয়ার রহমান, আমরা জলঢাকা ও ডিমলা উপজেলার মানুষ অনেক শান্তিতে বসবাস করছিলাম। ৪০ ও ৬২ সালের রেকর্ডে এসব জমি আমাদের বাপ-দাদার নামেই ছিলো। কোনো প্রকার জলাধার বা নদী ছিল না। কিন্তু ব্যারেজ নির্মাণ করে আমাদের প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। তাদের এই প্রকল্পে কখনো উন্নতি দেখি নাই। তারা পানি আটকিয়ে আমাদেরকে ভাতে মেরেছে। কিন্তু তারা কোনো প্রকার ফল পায়নি। পরে তারা এখানে মাছ চাষ শুরু করে। তারপরেও তাদের সফলতা নেই। এখন তারা এখানে আবার ধলাধার খনন করার চেষ্টা করছে। আমরা বাধা দিয়েছি বলে আমাদেরকে অন্যায়ভাবে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের দোসর এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকারের দাফটে বিভিন্ন মামলার আসামি করে হয়রানি করা হচ্ছে। আমরা চাই এই ভুয়া প্রকল্প বাতিল করে আমাদের খেয়ে বাঁচতে দেন। আমাদের শান্তিতে থাকতে দেন।
জলঢাকা উপজেলার চিড়াভিজা গোলনার আব্দুর রশিদ বলেন, ব্যারেজ নির্মাণের পরে আমাদের বাপ-দাদার জমিতে পানিতে ডুবে যায়। সেসময়ে আমাদের চরম দুর্দিন গেছে। বাহিরে গিয়ে কাজ করে খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়েছে। ফসল তলিয়ে যাওয়ায় জলাধার থেকে শাপলা ফুলের ঢ্যাব তুলে খেতে হয়েছে। কিন্তু তারা ফসলের ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়ে জমির মালিকানা দাবি করছে। এখন তারা এই জমিতে জলাধার খনন করতে চায়। তারা জলাধারে পানি জমিয়ে পিছনের জমিতে সেচ দিবে মাত্র একবার। আর আমরা এই জমিতে ফসল ফসলাচ্ছি তিন থেকে চার বার। আমরা চাই এই প্রকল্প বাতিল করে আমাদেরকে স্বাভাবিক ভাবে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ করে দেয়া হউক। এই জমিতে জলাধার খনন হলে আবারো আমাদের খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হবে।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশল আতিকুর রহমান বলেন, বুড়ি তিস্তা ধলাধার খননে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছে। রিজার্ভারের জন্য ও বুড়ি তিস্তার জন্য জমি অধিগ্রহণ ১৯৫৬-৫৭ সাল থেকেই শুরু হয়েছে। আর ১৯৯২-৯৩ সালে অধিগ্রহণের কাজ শেষ হয়েছে। আমরা ১৭টি এলেকেসের মাধ্যমে ১২১৭ দশমিক ৬১ একর জায়গা অধিগ্রহণ করেছি। বর্তমানে আমাদের অধিগ্রহণকৃত জায়গায় স্থানীয়দের মাত্র ১৭টি স্থাপনা রয়েছে। অধিগ্রহণকৃত জায়গার ৬৬৭ একরে জলাধার খনন হবে। এই খনন কাজের চলাকালে বিভিন্ন সময়ে আমরা স্থানীয়দের কাছে হামলার স্বীকার হয়েছি।
এজন্য ডিমলা থানায় একটি, জলঢাকা থানায় ছয়টি ও আদালতে তিন মামলা করা হয়েছে। মামলায় ৩০ থেকে ৬০ জনকে নামীয় আসামি আর বাকি কিছু অজ্ঞাত আসামিও রয়েছে। এটি একটি সরকারের লাভজনক প্রকল্প। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে প্রতিবছর অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন হবে ২৬ লাখ মেট্রিক টন, সাড়ে ১৫ কোটি টাকার জ্বাালানির সাশ্রয়, সারের সাশ্রয় ২ কোটি টাকার আর এতে পরিবেশেরও ভারসাম্য রক্ষা হবে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা চান তিনি।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান বলেন, বুড়িতিস্তা খনন কাজ দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁলে আছে। আমরা আসার পর থেকে এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড এই কাজ সম্পাদনের জন্য কয়েকবার অনুরোধ করেছে এই খনন পরিচালনায় ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের জন্য। এছাড়াও অধিগ্রহণকৃত জমির মধ্যে ব্যক্তিগত স্থাপনা উচ্ছেদের জন্য একটি তালিকাও দিয়েছে। সাধারণ মানুষও প্রকল্প বন্ধের দাবি জানিয়ে স্বারকলিপি দিয়েছে। আমরা চাই উভয়পক্ষ বসে একটা সুষ্ঠু সমাধান। যাতে সরকারের এই উন্নয়নমূলক প্রকল্পও বাধাগ্রস্ত না হয় আর সাধারণ মানুষেরও ক্ষতি না হয়।
আপনার মতামত লিখুন :