ভারতের সাথে দাসমূলক বন্ধুত্বের পুরস্কার হলো আদানি বিদ্যুৎ চুক্তি


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : নভেম্বর ২৫, ২০২৪, ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ /
ভারতের সাথে দাসমূলক বন্ধুত্বের পুরস্কার হলো আদানি বিদ্যুৎ চুক্তি

বিদেশী কোনো দেশ থেকে দেশের জন্য কিছু কিনতে হলে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। দুই দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো শর্ত আছে কি না- তা যাচাই-বাছাই করতে হয়। শর্ত না মানলে জরিমানার পরিমাণ উল্লেখ থাকতে হয়। এমনকি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সাথেও সরকারের কোনো চুক্তি থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাইয়ে কাগজপত্র দাখিল করতে হয়। কিন্তু ভারতীয় প্রতিষ্ঠান আদানির কাছ থেকে চুক্তি করার জন্য এ ধরনের কোনো কিছুই মানা হয়নি। হাজারো চেষ্টা করেও মূল চুক্তির কোনো কাগজপত্র পাওয়া যায়নি।

এক তরফাভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষার জন্য অন্ধের মতো কাগজে স্বাক্ষর করা হয়েছে। তাই ভারতের সাথে বিদ্যুৎ ক্রয়ের কোনো চুক্তি হয়নি, বরং পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের ভারতের সাথে দাসমূলক বন্ধুত্বের পুরস্কার হিসেবে আদানির কাছে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এ কারণেই দেশের জনগণের কষ্টের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আদানির পকেটে চলে যাচ্ছে।

গতকাল নয়া দিগন্তের সাথে কথাগুলো বলেছেন পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমাত উল্লাহ। তিনি দেশবিরোধী এ চুক্তি অবিলম্বে বাতিলের অনুরোধ করেন সরকারের কাছে।

এ দিকে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পতিত হাসিনার শাসনামলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্রয় ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় আকারের যেসব চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে সেগুলো পুনর্মূল্যায়নের কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে এমন ডজন খানেক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুনর্মূল্যায়নের কাজ চলমান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- আদানি (গোড্ডা) বিআইএফপিসিএল ১২৩৪.৪ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেঘনাঘাট ৩৩৫ মেগাওয়াট দ্বৈত জ্বালানি (তরল জ্বালানি ও গ্যাস), আশুগঞ্জ ১৯৫ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাঁশখালী ৬১২ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেঘনাঘাট ৫৮৩ মেগাওয়াট দ্বৈত জ্বালানি (তরল জ্বালানি ও গ্যাস), মেঘনাঘাট ৫৮৪ মেগাওযাট গ্যাস/আরএলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুকেন্দ্র ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। গতকাল পুনর্মূল্যায়ন কমিটি, টেন্ডার ছাড়াই অসম চুক্তি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি পর্যালোচনায় সহায়তার জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় রিভিউ কমিটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে একটি খ্যাতনামা আইনি ও তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছে।

গতকাল বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিটি সরকারকে এই পরামর্শ দেয়। একইসাথে তারা বিশেষ প্রস্তাবে জানিয়েছে, বিদ্যুৎ ক্রয়ে আহ্বানকৃত এবং অনাহ্বানকৃত চুক্তিগুলোর বিস্তারিত রিভিউ করার জন্য তাদের আরো সময়ের প্রয়োজন। কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তারা এমন সব প্রমাণ সংগ্রহ করছেন, যা আন্তর্জাতিক সালিশি আইন ও কার্যক্রম অনুযায়ী চুক্তিগুলোর বিষয়ে পুনরায় আলোচনা বা বাতিল করার সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, ‘আমাদের কাজ সহজতর করা এবং আমাদের কমিটিকে সহায়তার জন্য এক বা একাধিক শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক আইনি ও তদন্তকারী প্রতিষ্ঠানকে অবিলম্বে নিয়োগ করার সুপারিশ করছি।’ কমিটির পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয় যে, তাদের তদন্ত আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হবে এবং আন্তর্জাতিক আলোচনা ও সালিশিতে গ্রহণযোগ্য হবে।

বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বশীল এক সূত্র জানিয়েছে, ভারতের আদানির বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিতে পদে পদে অনিয়ম বের হয়ে আসছে। এরই মধ্যে আদানি গ্রুপের সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা সব বিদ্যুৎ চুক্তি পর্যালোচনার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদানির বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিতে পাওয়া গেছে নানা অনিয়ম। ওই ভারতীয় কোম্পানির বিদ্যুৎ চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরের যে রুট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, তা কোনো শুল্ক স্টেশনই নয় বলে জানিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।

এ ছাড়া রয়েছে- করমুক্ত আমদানি নীতি, কয়লার বাড়তি দর, বিলম্বে বিল পরিশোধে অতিরিক্ত সুদ আরোপের জটিলতাসহ নানা অনিয়ম। আদানির চুক্তিতে উল্লেখ আছে, আমদানি পর্যায়ে শুল্ক কর মওকুফের আদেশ যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনুমোদনে দায়বদ্ধ থাকবে পিডিবি। পরে কোনো শুল্ক-করের প্রসঙ্গ এলে, তা পরিশোধের দায়ও নিতে হবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি)। এ ছাড়া বিল পরিশোধে বিলম্বের জন্য বছরে ১৫ শতাংশ চড়া সুদ ধরা আছে আদানির চুক্তিতে, যা পায়রায় নেই। এমন সব জটিলতার মধ্যেই বিদ্যুতের ২২ শতাংশ বাড়তি দাম নতুন করে চাইছে আদানি। পাশাপাশি আছে বকেয়া বিল পরিশোধের চাপও।

বিষয়টি নিয়ে পাওয়ার সেলের সাবেক ডিজি বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, পিডিবির পক্ষ থেকে জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টি যথাযথভাবে খতিয়ে দেখা হয়নি। চুক্তির প্রতিটি ধারা উপধারা প্রকাশ করতে হবে। এমনি পরিস্থিতি বাড়তি মূল্য ভারতীয় কোম্পানি আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। আদানির সাথে সম্পাদিত চুক্তি বাতিল করা উচিত। কারণ, ২৫ বছরে আদানি শুধু ক্যাপাসিটি চার্জই নেবে এক লাখ কোটি টাকার ওপরে। আর তেলের দাম ও ডলারের দাম বেড়ে গেলে ক্যাপাসিটি চার্জও বেড়ে যাবে।

এমনি পরিস্থিতিতে আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনা মোটেও ঠিক হবে না। এতে জনদুর্ভোগ আরো বাড়বে। বেড়ে যাবে অর্থনীতির রক্তক্ষরণ। তিনি বলেন, এ চুক্তিতে কি আছে তা-ও জনগণ জানে না। অথচ একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনছি, কত মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে এবং বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে কি আছে তা সবার জানার অধিকার আছে। তিনি বলেন, অবিলম্বে এ চুক্তি জনগণের সামনে তুলে ধরা হোক।

বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, চুক্তির কপি আমরা এখনো হাতে পাইনি। তবে, দেশী বিদেশী বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাংলাদেশের অন্যান্য কেন্দ্রের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। এমনকি কয়লার মূল্যও ধরা হয়েছে দেশের পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ বেশি। এতে আদানির বিদ্যুৎ কেনায় খরচ পড়বে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয়ের চেয়ে প্রায় তিন গুণ। ভারতের ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় স্থাপিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র সমুদ্রবন্দর থেকে বেশি দূরে হওয়ায় কয়লা পরিবহন ব্যয় বেশি হবে, যার ব্যয় বহন করতে হবে বাংলাদেশকে।

পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ আরো বলেন, বিনা টেন্ডারে ভারতের কোম্পানি আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ কেনা মোটেও ঠিক হবে না। কারণ, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বর্তমানে ২৬ হাজার মেগাওয়াট হয়েছে। এমনিতেই বেশি। এর ওপর ভারতের কোম্পানি আদানির কাছ থেকে কেন বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের জন্য আন্তর্জাতিক কোনো টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছিল কি না তা জনগণ জানে না। কিভাবে বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ হলো তা-ও কারো জানা নেই। এ কারণে আদানির সাথে বাংলাদেশে সম্পাদিত চুক্তি জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হোক। কারণ জনগণই ক্রেতা। জনগণই বিদ্যুৎ কিনবে। সুতরাং জনগণের অন্ধকারে রেখে বিদ্যুৎ চুক্তি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এতে দেশের অর্থনীতিতে রক্ত ক্ষরণ আরো বেড়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।