গত ১২ মার্চ থেকে চার মাস আট দিন বন্ধ দেশের এই বৃহত্তম সার কারখানা। এর আগেও ২০২৪ সালে দুই দফায় দীর্ঘ ১২৫ দিন বন্ধ ছিল এই কারখানা, পেট্রোবাংলা গ্যাস সরবরাহের কোনো সিদ্ধান্ত জানাচ্ছে না। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা সদরে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকায় নির্মিত দেশের অন্যতম বৃহত্তম শাহজালাল ইউরিয়া সার কারখানার উৎপাদন চার মাস আট দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। গ্যাসসঙ্কটের কারণে গত ১২ মার্চ এই সার কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে ২০২৪ সালে দুই দফায় এই কারখানায় দীর্ঘ ১২৫ দিন উৎপাদন বন্ধ ছিল।
দীর্ঘদিন উৎপাদন বন্ধ থাকায় শাহজালাল ইউরিয়া সার কারখানা বিপুল অঙ্কের ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে হাজার কোটি টাকার মতো। এদিকে উৎপাদন বন্ধ থাকায় দেশের ৪০০ হিমাগারের মূল উপাদান আ্যমোনিয়া সরবরাহ করতে পারছে না শাহজালাল সার কারখানা।
গত বছরের মার্চ থেকে চলতি সালের ২০ জুলাই পর্যন্ত তিন দফা বন্ধ রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই কারখানা। ২০২৪ সালের ১৩ মার্চ যান্ত্রিক ত্রুটি ও গ্যাসসঙ্কটের কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল শাহজালাল সার কারখানা। এ দফায় কারখানাটি বন্ধ থাকে ১০১ দিন। পরবর্তীতে একই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর গ্যাসসঙ্কটের কারণে আবার কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে আবার উৎপাদনে যায় সার কারখানা। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিন ওভারহোলিং না করায় যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ে এই সার কারখানা। চলতি বছর ১২ মার্চ উৎপাদন বন্ধ হওয়ার ১৫ দিনের মাথায় যান্ত্রিক ত্রুটি কাটিয়ে উঠলেও অদ্যাবধি সার কারখানার উৎপাদন শুরু করা যায়নি। তিন দফা উৎপাদন বন্ধ থাকায় সার কারখানায় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে হাজার কোটি টাকারও বেশি।
সার কারখানার জিএম (অ্যাডমিন) এ টি এম বাকি গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, গ্যাসসঙ্কটের কারণে শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পেট্রোবাংলার সাথে আলাপ আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। তিনি জানান, ‘গ্যাসসঙ্কটের সমাধান না হলে খুব সহসা উৎপাদনে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।’
তিনি আরো জানান, শাহজালাল ইউরিয়া সার কারখানায় উৎপাদন নিশ্চিত করতে দৈনিক ৪০ এমএমসিএফটি গ্যাসের প্রয়োজন হয়। এই পরিমাণ গ্যাস আমরা চেয়ে আসছি দীর্ঘদিন থেকে। কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
জানা গেছে, শাহজালাল সার কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পেট্রোবাংলার সাথে গত চার মাসে কয়েকবার বৈঠকে বসেছেন। কিন্তু এসব আলোচনা ও বৈঠকের কোনো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না। সার কারখানার একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দৈনিক প্রায় ১১শত টন ইউরিয়া সার উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এই কারখানায় গড়ে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে পাঁচ কোটি টাকারও বেশি। সেই হিসেবে তিন দফা বন্ধের কারণে শাহজালাল সার কারখানায় ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকা। এ দিকে, শাহজালাল সার কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকায় দেশের চার শ’ হিমাগারে তরল অ্যামোনিয়া সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের হিমাগার পরিচালনার প্রধান কেমিক্যাল তরল অ্যামোনিয়া গ্যাস সংগ্রহ করা হতো শাহজালাল সার কারখানা থেকে। দেশে প্রায় চার শ’ হিমাগার রয়েছে।
পেট্রোবাংলার স্থানীয় কোম্পানি সিলেটের জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম কোম্পানির তিনজন কর্মকর্তার সাথে শাহজালাল সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিয়ে কথা বলতে চাইলে তারা এ সম্পর্কে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
জানা গেছে, শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) ছয়টি বৃহৎ ইউরিয়া সার কারখানায় দেশের চার শ’ হিমাগারের অ্যামোনিয়া গ্যাস উৎপাদন হতো আগে। শাহজালাল সার কারখানার টেকনিক্যাল বিভাগ জানায়, তরল অ্যামোনিয়া হচ্ছে ইউরিয়া ও অ্যামোনিয়া সারের মধ্যবর্তী একটি প্রোডাক্ট। ইউরিয়া ও অ্যামোনিয়ার মূল কাঁচামাল প্রাকৃতিক গ্যাস (মিথেন) বাতাস ও পানি।
দেশের অন্যান্য ইউরিয়া সার কারখানায় হিমাগার ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত তরল অ্যামোনিয়া উৎপাদন হতো কিন্তু বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গ্যাস সঙ্কটজনিত কারণে দেশের অন্যান্য পাঁচটি সার কারখানা বন্ধ রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে সিলেটের শাহজালাল সার কারখানাও গ্যাসসঙ্কটে কিছুদিন বন্ধ রাখলেও বিগত বছর থেকে সিলেটের এই সার কারখানা চালু রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে একের পর এক তিন দফায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে পড়ায় তরল অ্যামোনিয়া সঙ্কট দেখা দেয়।
ফেঞ্চুগঞ্জে নবনির্মিত শাহজালাল সার কারখানায় পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। দৈনিক ১৭৬০ মেট্রিক টন দানাদার ইউরিয়া ও ১০০০ মেট্রিক টন অ্যামোনিয়া উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে চায়নার ‘মেসার্স কমপ্ল্যান্ট’ ফেঞ্চুগঞ্জে শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড নামে এই সার কারখানা স্থাপন করে। এতে ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা।
এই কারখানা থেকে বিসিআইসির এনলিস্টেড ৭৯ জন ডিলার দেশের হিমাগার ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য নিয়মিত তরল অ্যামোনিয়া সংগ্রহ করতেন। বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত তরল অ্যামোনিয়া সংগ্রহের এই প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। শাহজালাল সার কারখানায় পাঁচ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার দু’টি অ্যামোনিয়ার রিজার্ভ ট্যাংক রয়েছে। অ্যামোনিয়া থেকেই ইউরিয়া সার তৈরি করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত গড়ে দৈনিক হাজার টনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল সার কারখানার উৎপাদন। উৎপাদন হ্রাসের জন্য সময়মতো ওভারহোলিং (পুনঃসংস্কার) না হওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে।
শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আশরাফুল ইসলাম নয়া দিগন্তকে জানান, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে ওভারহোলিংয়ের জন্য বারবার জানানো হলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বিলম্ব হয় সংস্কারকাজ। চলতি বছরে ওভারহোলিংয়ের কাজ অনেকটাই সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে গ্যাসসঙ্কটের কারণে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :